শিশুকাল থেকেই জীবিকা যোগাতে হয় তাদের

অন্যান্য ডেস্ক , আর ডি ঃমানুষ মাত্রই শিশু, শব্দটি শুনলে মনের মধ্যে জন্মনেয় এক শিহরণ। যার বহি:প্রকাশ হতে পারে একমাত্র মানবিকতার মাধ্যমে। কিন্তু আমরা দিন দিন যেন এই শব্দটির অপপ্রযোগে হয়ে উঠছি আরও অমানবিক এবং রূঢ়। ধর্মীয় আলোকেও শিশুকে ফুলের সাথে তুলনা করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা সব কিছুকেই ম্লান করে দিচ্ছে।

গ্রাম গঞ্জে, অলিতে গলিতে, শহরের সবখানে শিশুশ্রমের কঠোর নিষ্ঠুরতা লক্ষ্য করা যায়। জীবন সংগ্রামে নত হয়ে শিশুরা ধীরে ধীরে এগিয়ে জীবননামের করুণ পরিণতির দিকে। ম্লান হয়ে যাচ্ছে তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের লক্ষ্য। বিশেষত দরিদ্র পরিবারের অভিভাবকরা সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে ব্যর্থ হলে সে সব সন্তানদের পড়ালেখা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তাদেরকে পরিবারের পক্ষ থেকেই নামিয়ে দেয়া হয় জীবন সংগ্রামে। হোটেল, রেস্টুরেন্ট, চায়ের দোকান, ইটের ভাটা কিংবা ইটভাঙ্গার মতো অতি পরিশ্রমের কাজ করতে হয় তাদেরকে। এভাবে দিন দিন শিশুশ্রম বেড়েই চলেছে।

অষ্টম শ্রেণিতে বার্ষিক পরীক্ষায় শিশুটি প্রথম স্থান অধিকার করেছিলো। কিছুদিন আগে তার নবম শ্রেণিতে নাম নিবন্ধন করার কথা ছিল। কিন্তু পরিবার একসঙ্গে ৪০০ টাকা দিতে না পারায় এখনো শিশুটি নিবন্ধন করতে পারেনি। এখন সে বাবার সঙ্গে রাজশাহীর সাহেববাজার এলাকায় মাছ বিক্রি করছে।

এই শিশুর মতো রাজশাহী নগরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, রেস্তোরাঁ, মোটরসাইকেল গ্যারেজ কিংবা যানবাহনে কাজ করতে দেখা যায় শিশুদের। তাদের কেউ বিদ্যালয়ে যাওয়ার পাশাপাশি পরিবারকে অর্থনৈতিক সহায়তা করতে কাজ করে। আবার কেউ বিদ্যালয়ে যাওয়া ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি কাজে নেমেছে।

গত কয়েক দিনে নগরের সাহেববাজার, কেদুর মোড়ের মাছের দোকান, রেলগেট এলাকার মোটরসাইকেল গ্যারেজ, কাজলা এলাকার ওয়েল্ডিং কারখানায় শিশুদের কাজ করতে দেখলাম। যে বয়সে হাতে বই-খাতা থাকার কথা সেই হাতে ধরে নিয়েছে সংসারের হাল।

সাহেববাজারে মাছের দোকানে কাজ করা একটি শিশুর দৈনিক আয় হয় ২০০ টাকা। বর্তমানে সে বিদ্যালয়ে যাচ্ছে না। দুই ভাই-বোনের মধ্যে সে সবার বড়। সে জানায়, পড়াশোনায় তার আর মন বসছে না। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত মাছের দোকানে থাকে। এরপর বাসায় ফিরে টিভি দেখে। দুপুরে খেয়ে ঘুমিয়ে বিকেলে ঘুরতে বের হয়। বাসায় ফেরে রাত নয়টার দিকে।

রেলগেট এলাকার একটি মোটরসাইকেল গ্যারেজে কথা হয় অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া আরেক শিশুর সঙ্গে। তার বাবা বাসচালক। দুই ভাইবোনের মধ্যে সে বড়। দুই বছর ধরে মোটরসাইকেল গ্যারেজে কাজ শিখছে। তবে গ্যারেজে কাজের চাপ থাকায় নিয়মিত বিদ্যালয়ে যেতে পারে না। সপ্তাহে গ্যারেজ মালিক তাকে হাজারখানেক টাকা দেন।

বিদ্যালয়ে নিয়মিত না গিয়ে গ্যারেজে কাজ শেখার কারণ জানতে চাইলে সে জানায়, তার বাবার হার্টের অসুখ আছে। যেকোনো সময় অবস্থা গুরুতর হতে পারে। এ আশঙ্কায় সে এখন থেকেই কাজ শিখছে। কাজ শেখা শেষ হলে নিজেই একটা গ্যারেজ দেবে।

বাবার মৃত্যু ও মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের পর মো. রনি হাসানের পরিবারে জায়গা হয়নি। রনির ভাষায়, তার ছয়-সাত বছর বয়সে তাকে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর নাটোর থেকে ট্রেনে চেপে রাজশাহীতে আসে সে। এখন সে জিরোপয়েন্টে একটি চায়ের দোকানে কাজ করে।

দারিদ্র্যের কারণে শিক্ষা ও সুরক্ষাবঞ্চিত এসব শিশু শৈশব থেকেই নিজেদের দায়িত্ব নিজেরা নেয়। শিশুশ্রম দমন করতে প্রয়োজন সঠিক ভাবে সমাজ ভিত্তিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সচেতনতা মূলক মত গড়ে তোলা। সভা, সেমিনারের মাধ্যমে এ কাজটি করা যেতে পারে। যদি এমনি ভাবে এক একটি ফুলকে ঝরে যাবার হাত থেকে রক্ষা করা যায় তাহলে গোটা জাতির মঙ্গল।

সবশেষ বিবিএস জাতীয় শিশুশ্রম সমীক্ষা ২০১৩ অনুসারে, প্রায় ১৭ লাখ ৫০ হাজার শিশুশ্রমে যুক্ত। ২০২৫ সালের মধ্যে সরকার শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্য ঠিক করেছে।

১২ জুন পালিত হয় বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিলো ‘সামাজিক সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করি, শিশুশ্রম বন্ধ করি’। রাজশাহীতে শিশুশ্রম প্রতিরোধে একটি উদ্যোগ বাস্তবায়নে কাজ করছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। তাদের লক্ষ্য ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম শূন্যের কোঠায় আনা।

আমরা কত নিষ্ঠুর ভাবে একেকটি শিশু নামের ফুলকে পায়ের নীচে মাড়িয়ে হত্যা করছি। নষ্ট করে দিচ্ছি ভবিষ্যত। এর উত্তর দেবার কেউ নেই। অন্ধের দেশে আয়না বিক্রি করা যেমন অসম্ভব তেমনি সমাজ ও দেশ থেকে কুসংস্কার নির্মূল করা কঠিন ব্যাপার। দেশে এখন উদ্বেগজনক হারে শিশুশ্রম বেড়ে চলেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে একসময় শিশু শ্রমিকের দেশে পরিণত হবে এ দেশ। এ অবস্থায় অভিভাবকের সামর্থ না থাকলে শিশুর জন্যে অবৈতানিক শিক্ষা, উপবৃত্তির সুব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। বিদ্যালয়ের সমূদয় খরচ এমনকি পরীক্ষা ফি পর্যন্ত মওকুফ করে শিশুর জন্যে চিন্তা মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। আর এই কাজটি সরকারকেই করতে হবে। যেনো আর কোনো শিশুর ভবিষ্যৎ অন্ধকার না হয়ে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *