পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের আদ্যোপান্ত

১৯৮৪ সালের কথা মনে পড়ে। ঐ বছরের মার্চ মাসে যখন ইংল্যান্ডে পড়াশোনার জন্য বিমানে রওনা হই এবং ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে যখন হিথরো এয়ারপোর্টের উদ্দেশে ইংল্যান্ডের মাটির ওপরে বিমান উড়তে থাকে। তখন বেশ কতগুলো স্থানে মোটা মোটা চিমনি দিয়ে সাদা ধোঁয়া বের হতে দেখি। এ ব্যাপারে এয়ার হোস্টেসকে জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারি, এগুলো পারমাণবিক  বিদ্যুৎকেন্দ্র। সেই সময় ভাবতে থাকি যে আমাদের দেশে কোনো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নেই। যদিও পাকিস্তান আমলে ১৯৬১ সালে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলাধীন পাকশী ইউনিয়নের রূপপুর গ্রামে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নামে একটি পারমাণবিক চুল্লি করার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়, কিন্তু বাস্তবায়ন হতে বহু বছর লাগল। বর্তমানে রূপপুর আণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কার্যক্রম জীবন্ত হয়ে উঠেছে। শুধু তাই নয়, এই কেন্দ্র আগামী বছরের প্রথম দিকে উৎপাদনে যাবে এবং দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার ১০ শতাংশ সরবরাহ করতে সক্ষম হবে বলে জানা যায়। এ ব্যাপারে এই প্রবন্ধের স্বার্থে বিদ্যুৎ নিয়ে কিছুটা কথা বলা আবশ্যক বলে মনে করি। এর প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, প্রতিটি পদার্থ অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা দ্বারা গঠিত, এদের পরমাণু বলে। প্রতি পদার্থের পরমাণুতে, নিউক্লিয়াসের চারদিকে ঘূর্ণায়মান ইলেকট্রন বিদ্যমান। আর নিউক্লিয়াসের মধ্যে দুই ধরনের কণা থাকে—প্রোটন ও নিউট্রন। উল্লেখ্য, পদার্থ সৃষ্টিকারী প্রায় কণাসমূহের (ইলেকট্রন ও প্রোটন) মৌলিকত্বসহ এর বৈশিষ্ট্যমূলক ধর্মই হচ্ছে আধান বা চার্জের (Charge) আওতাভুক্ত। আর ইলেকট্রনের আধান ঋণাত্মক এবং প্রোটনের আধান ধনাত্মক হিসেবে বিদ্যমান। কিন্তু নিউট্রন নিরপেক্ষ বিধায় এতে কোনো আধান নেই। একটি প্রোটনের আধানের পরিমাণ ইলেকট্রনের আধানের সমান হয়ে থাকে। তাই একটা গোটা পরমাণুতে কোনো বৈদ্যুতিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায় না। মূলত বিভিন্ন পদার্থের পরমাণুতে প্রোটন ও ইলেকট্রনের সংখ্যা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। এদিকে দুটি ভিন্ন বিভবের বস্তুকে যখন পরিবাহী তার দ্বারা সংযুক্ত করা হয়। তখন নিম্ন বিভবের বস্তু থেকে উচ্চ বিভবের বস্তুতে ইলেকট্রন প্রবাহিত হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত বস্তুদ্বয়ের মধ্যে বিভবের পার্থক্য শূন্য না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত এই প্রবাহ বজায় বা চলতে থাকে। আর কোনো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যদি বস্তুদ্বয়ের মধ্যে বিভব পার্থক্য বজায় রাখা যায়, তাহলে এই ইলেকট্রন প্রবাহ নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকে। ইলেকট্রনের এই নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহই হলো তড়িৎ বা বিদ্যুৎ। সাধারণত ঘর্ষণের ফলে এক বস্তু থেকে অপর বস্তুতে ইলেকট্রন স্থানান্তরিত হয়। ইলেকট্রনের মৌলিক ও বৈশিষ্ট্যমূলক ধর্ম হচ্ছে আধান বা চার্জ (Charge), যা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। সেহেতু ঘর্ষণে বস্তু আধানগ্রস্ত বা চার্জিত হয়ে থাকে। আর আধানের প্রকৃতি ও প্রবাহকে বলা হয় তড়িৎ বা বিদ্যুৎ, যা ইতিপূর্বেই বলেছি। এদিকে খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় ৬০০ বছর আগে গ্রিক দার্শনিক থেলিস (Thales 640-548 B.C) প্রথম পর্যবেক্ষণ করেন যে সোলেমানি পাথর বা অ্যাম্বারকে (পাইনগাছের শক্ত আঠা) রেশমি কাপড় দিয়ে ঘষলে এগুলো ছোট ছোট কাগজের টুকরোকে আকর্ষণ করে থাকে। কিন্তু আকর্ষণ করার মূল কারণ বুঝতে সময় লেগে যায় পাক্কা দুই হাজার বছরেরও বেশি। উল্লেখ্য, অ্যাম্বারের (Amber) গ্রিক ভাষায় নাম ইলেকট্রন (Electron) আর এটি থেকে ইলেক্ট্রিসিটি (Electricity) বা তড়িৎ তথা বিদ্যুৎ শব্দের উদ্ভব হয়েছে। অবশ্য এই সূত্র ধরে ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে রানি এলিজাবেথের গৃহচিকিত্সক উইলিয়াম গিলবার্ট গবেষণার পর ঘর্ষণজনিত বিদ্যুতের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের নাম ইলেক্ট্রিসিটি কথাটি প্রবর্তন করেছেন বলে জানা যায়। আর একটি কথা, আমরা যে ঋণাত্মক ও ধনাত্মক কথা বলি, সে ব্যাপারে স্বনামধন্য বৈজ্ঞানিক বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিনের কাছে ঋণী। তাছাড়া বিদ্যুৎ নিয়ে যাদের অবদান কভু ভুলবার নয়, তারা হলেন আলেকজান্ডার ভোল্টা, মাইকেল ফ্যারেডে, ওহম, কারশপ, কুলম্ব, লেঞ্জ, টেসলা, জন সিল্ভা, আলভা এডিসন, উইনস্টোন প্রমুখ। যা হোক, বর্তমান আধুনিক বিশ্বে বিদ্যুৎ বিভিন্ন মাধ্যমে উৎপন্ন করা হয় যেমন—কয়লা, তেল ও গ্যাস পুরিয়ে তাপ সৃষ্টি করে; জলবিদ্যুৎ; সূর্যকিরণ তথা সোলার বিদ্যুৎ; বায়ুচালিত পাখার মাধ্যমে বিদ্যুৎ (উইন্ডমিল); রাসায়নিক বিদ্যুৎ যেমন ব্যাটারি; সমুদ্রের ঢেউয়ে বিশেষ ধরনের বেলুন রেখে বিদ্যুৎ এবং সর্বোপরি আলোচনার বিষয়বস্তু পারমাণবিক শক্তির দ্বারা বিদ্যুৎ উৎপাদন। এখন শুধু পারমাণবিক বিদ্যুৎ নিয়ে সম্মানিত পাঠক-পাঠিকার উদ্দেশে কিছু কথা বলছি। আর সংগত কারণেই এ ব্যাপারে গোড়ায় চলে যাই। এই সূত্র ধরে উল্লেখ করা যায়, ১৭৮৯ সালের দিকে বিজ্ঞানী মার্টিন হেনরিখ ক্ল্যাপরথ ইউরেনিয়াম আবিষ্কার করেন। এটি যে কত বড় আবিষ্কার, তা বলে বোঝানো যাবে না। কেননা, মানুষ যখন বিশ্বকে আরো গতিশীল করার জন্য শক্তির (Energy) ব্যাপারে চিন্তিত, ঠিক তখনই এটি একটি বড় নিয়ামক হিসেবে দেখা দেয়। যা হোক, এটি ইউরেনাস গ্রহের নামানুসারে নামকরণ করা হয়। সত্যি কথা বলতে, প্রথম ইউরেনিয়াম সংগ্রহ করা হয় ১৮৪১ সালে। আর সেই বছর বিজ্ঞানী ইউজিন পেলিকট ইউরেনিয়াম টেট্রাক্লোরাইড থেকে প্রথম ইউরেনিয়াম সংগ্রহ করেন। এদিকে ১৮৬৯ সালে যখন দিমিত্রি মেন্ডেলিভ পর্যায় সারণি (Periodic Table) আবিষ্কার করেন, তখন ইউরেনিয়াম ভারী মৌল হিসেবে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এখানেই শেষ নয়। কেননা, ১৮৯৬ সালে বিজ্ঞানী হেনরি বেকেরেল ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার করেন। এর সূত্র ধরে উল্লেখ করা যায়, বিষয়টি জটিল বিধায় আসুন আমরা পারমাণবিক শক্তি সম্পর্কে সম্যক ধারণার জন্য কিছুটা খোলাখুলি আলোচনা করি। পূর্বেই আলোকপাত করেছি, প্রতিটি পদার্থ পরমাণু নামক অসংখ্য অতি ক্ষুদ্র কণা দ্বারা গঠিত। সব মৌলের পরমাণুতে থাকে ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন। নিউট্রন ও প্রোটন পরমাণুর কেন্দ্র নিউক্লিয়াসে অবস্থান করে। আর ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের বাইরে অবস্থান করে। পরমাণু সামগ্রিকভাবে কোনো চার্জযুক্ত থাকে না। নিউট্রন চার্জবিহীন, তাই পরমাণুতে ইলেকট্রন ও প্রোটনের সংখ্যা সমান থাকে। কেননা, প্রোটন ও ইলেকট্রনের আধান বিপরীতধর্মী। এদিকে একই মৌলের বিভিন্ন পরমাণুর কয়েক প্রকারের ভর হতে পারে। ভর হলো প্রোটন ও নিউট্রনের সর্বমোট সংখ্যা। কিন্তু যেসব পরমাণুর প্রোটনসংখ্যা সমান অথচ ভর ভিন্ন হয়, সেই সব পরমাণুকে পরস্পরের আইসোটোপ বলা হয়। এতে প্রতীয়মান হয় যে, নিউট্রনের সংখ্যার তারতম্যের জন্যই আইসোটোপের সৃষ্টি। এদিকে একই মৌলের সব আইসোটোপের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম একই হয়ে থাকে। অবশ্য কতিপয় পরমাণু থেকে যে প্রতিভাসের সৃষ্টি হয়, তার নাম তেজস্ক্রিয়তা। এক্ষেত্রে ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম, প্লুটুনিয়াম ইত্যাদি হলো তেজস্ক্রিয় পদার্থ। আসলে পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে ভেঙে বা বিভাজন করে যে শক্তি পাওয়া যায়, তাকে পারমাণবিক শক্তি বলে। এর প্রেক্ষাপটে উল্লেখ করা যায়, ১৯০৫ সালে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন প্রমাণ করেন যে, পদার্থ ও শক্তি প্রকৃতপক্ষে অভিন্ন, অর্থাৎ পদার্থকে শক্তিতে রূপান্তরিত করা যায় এবং শক্তিকে রূপান্তরিত করা যায় পদার্থে। এই সূত্রে স ভরবিশিষ্ট কোনো পদার্থকে শক্তিতে রূপান্তর করলে যে শক্তি উৎপন্ন হয়, তার পরিমাণ E = mc2; এক্ষেত্রে C = আলোকের বেগ (3000,000km/sec)। এই প্রেক্ষাপটে ফিশনের (Fission) কথা এসে যায়। মূলত ফিশন হলো বিভাজন বা ভাঙন। একটি ভারী পরমাণুকে দ্রুতগ্রামী নিউট্রন দ্বারা ভেঙে হালকা ভরের একাধিক পরমাণু ও শক্তি উৎপন্ন করা হয়। এই প্রক্রিয়াকে কাজে লাগানো হয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে (Nuclear Power Plant)। যেসব তেজস্ক্রিয় পদার্থ এই ফিশন বিক্রিয়ায় অংশ নেয়, তাদের ফিসাইল পদার্থ বা পারমাণবিক জ্বালানি বলা হয়। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয় ইউরেনিয়াম ২৩৫ আইসোটোপ। মজার ব্যাপার হলো, তেজস্ক্রিয় কিছু আইসোটোপ আছে, যেগুলো বিশেষ অবস্থায় নিজেরাই নিজেদের পরমাণুকে ভেঙে তাপশক্তি বিকিরণ করে। সাধারণত ইউরেনিয়াম ২৩৫ পরমাণুর নিউক্লিয়াসে ৯২টি প্রোটন ও ১৪৩টি নিউট্রন থাকে। এরই পরমাণুতে বাইরে থেকে একটি নিউট্রন ঢুকিয়ে দিলে আইসোটোপ ইউরেনিয়াম-২৩৬-এ পরিণত হয়। এই আইসোটোপ নিজের অস্তিত্ব বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে না। তাই এর পরমাণুটি ভেঙে দুটি পরমাণুতে পরিণত হয়। ভেঙে যাওয়ার সময় পরমাণুটি প্রচুর তাপশক্তি উৎপন্ন করে দুটি অতিরিক্ত নিউট্রনকে মুক্ত করে দেয়। উক্ত মুক্ত নিউট্রন দুটি আবার ইউরেনিয়ামের নতুন দুটি পরমাণুকে ভেঙে প্রচুর তাপশক্তি উৎপন্ন করে চারটি নিউট্রনকে মুক্ত করে দেয়। এভাবে চলতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম-২৩৫-এর অস্তিত্ব থাকবে। আর এ ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়াকে বলা হয় চেইন রিঅ্যাকশন (Chain Reaction)।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *