তবে চীন নৌবাহিনীর শক্তিমত্তা আরও অনেক বাড়াতে চায় বলেই ধারণা করা হয়। ২০২০ থেকে ২০৪০ সালের মধ্যে চীনের নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজের সংখ্যা প্রায় ৪০ শতাংশ বাড়বে বলে অনুমান করছে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী।চীনের নৌবাহিনীর আরও সম্প্রসারণ প্রয়োজন বলে মনে করেন দেশটির পিপলস লিবারেশন আর্মির সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্নেল ঝউ বো। বেইজিংয়ের সিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ঝউ বো বলেন, সাগরে চীন যেসব হুমকির মুখে পড়ছে, সেগুলো সামাল দিতে দেশটির নৌবাহিনীর সম্প্রসারণ অতি জরুরি। তিনি বলেন, চীনের জলসীমায় যুক্তরাষ্ট্রের উসকানিকেই সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে দেখছেন তাঁরা।
বিপুল ব্যয়
প্রতিরক্ষা খাতে বিপুল অঙ্কের অর্থ খরচ করছে চীন। এ খরচের পরিমাণ নিয়ে দেশটির দেওয়া তথ্যে ‘স্বচ্ছতার ঘাটতি’ আছে বলে অভিযোগ করেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ। এমনকি চীনের দেওয়া হিসাবে গরমিল পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করেছেন তাঁরা।প্রতিরক্ষা খাতে খরচের হিসাব প্রকাশ করে বেইজিং। তবে এ হিসাবের আড়ালে সশস্ত্র বাহিনীর জন্য চীনের প্রকৃত খরচ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেশি বলে ধারণা পশ্চিমা বিশ্লেষকদের। মনে করা হয়, বর্তমান বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের পরেই সশস্ত্র বাহিনীর পেছনে সবচেয়ে বেশি অর্থ ঢালে চীন।চীনের কাছে ২০২১ সালে ২৭২টি পারমাণবিক অস্ত্র ছিল। চলতি দশকের শেষ নাগাদ চীন এই অস্ত্রের সংখ্যা চার গুণ বাড়াতে চায় বলে গত নভেম্বরে একটি অনুমানের কথা জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। তাদের ভাষ্যমতে, ২০৩০ সালের আগেই চীন অন্তত ১ হাজার পারমাণবিক বোমা হাতে রাখার পরিকল্পনা করছে।ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের দেওয়া তথ্য বলছে, অন্তত এক দশকে চীনের সামরিক বাজেট যে পরিমাণ বেড়েছে, তা দেশটির সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে গেছে।
পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত বাড়াচ্ছে চীন
চীনের কাছে ২০২১ সালে ২৭২টি পারমাণবিক অস্ত্র ছিল। চলতি দশকের শেষ নাগাদ চীন এ অস্ত্রের সংখ্যা চার গুণ বাড়াতে চায় বলে গত নভেম্বরে একটি অনুমানের কথা জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। তাদের ভাষ্যমতে, ২০৩০ সালের আগেই চীন অন্তত ১ হাজার পারমাণবিক বোমা হাতে রাখার পরিকল্পনা করছে।তবে চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ অনুমানকে ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে। তাদের দাবি, চীনের পারমাণবিক বোমার সংখ্যা একেবারে ‘ন্যূনতম পর্যায়ে’ রাখা হয়েছে।চীনের পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত নিয়ে কথা বলেছেন সুইডেনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞরা। কোন দেশের হাতে কয়টি পারমাণবিক অস্ত্র আছে, তার বার্ষিক হিসাব প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটি। তাঁদের ভাষ্য, কয়েক বছর ধরে পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা বাড়াচ্ছে চীন।যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এ মুহূর্তে ৫ হাজার ৫৫০টি পারমাণবিক বোমা রয়েছে। তাই সংখ্যার হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অনেকপিছিয়ে আছে চীন। তারপরও দেশটির পারমাণবিক অস্ত্রগুলোকে পশ্চিমা সামরিক বাহিনীর আধিপত্যের জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে।যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিস ইনস্টিটিউটের গবেষক ভিরলে নোয়েন্সের মতে, ‘চীনের পারমাণবিক অস্ত্রগুলো হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দুই পক্ষের মধ্যে আস্থার বড় ঘাটতি রয়েছে। সংলাপ আয়োজনের জন্য কাছাকাছি অবস্থানেও নেই তারা।’
হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র
হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো শব্দের পাঁচ গুণের চেয়ে বেশি গতিতে ছুটতে পারে। তবে আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের (আইসিবিএম) চেয়ে এর গতি কম। এরপরও হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র রাডারে শনাক্ত করা খুবই কঠিন। এ কারণে এগুলো অনেক আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে সহজেই ফাঁকি দিতে পারে।‘চীনের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি নিয়ে পশ্চিমাদের ভয় একেবারেই ভিত্তিহীন। যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্বের অন্য দেশগুলোর ওপর ছড়ি ঘোরানোর কোনো শখ নেই বেইজিংয়ের। এমনকি চীন যদি এক দিন আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তারপরও দেশটি তার নীতি মাথায় রেখে চলবে।’চীনের সাবেক পিপলস লিবারেশন আর্মির জ্যেষ্ঠ কর্নেল ঝউ বোলন্ডনের কিংস কলেজের অধ্যাপক ড. জেনো লিওনির ভাষ্যমতে, চীন বুঝেছে, তারা এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। তাই তারা পরাশক্তিগুলোর শক্তিমত্তার কাছাকাছি পৌঁছাতে সমরাস্ত্রে বড় ধরনের অগ্রগতি আনতে চাইছে। এ ক্ষেত্রে একটি উপায় হতে পারে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের উন্নয়ন।চীন অবশ্য হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালানোর বিষয়টি অস্বীকার করেছে। তবে পশ্চিমা বিশ্লেষকদের ধারণা, গত গ্রীষ্মে চীন থেকে দুটি রকেট ছোড়ার ঘটনা এটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে দেশটির সামরিক বাহিনী হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র হাতে পাওয়ার পথে রয়েছে।চীন কী ধরনের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে কাজ করছে, তা এখন পর্যন্ত পরিষ্কার নয়। এ ক্ষেপণাস্ত্রের মূলত দুটি ধরন রয়েছে। একটি হাইপারসনিক গ্লাইড ক্ষেপণাস্ত্র। এসব ক্ষেপণাস্ত্র পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ভেতর দিয়েই উড়ে যায়।অপরটি ফ্রাকশনাল অরবিটাল বোম্বার্ডমেন্ট সিস্টেম (এফওবিএস)। এটি বায়ুমণ্ডলের বাইরে পৃথিবীর কক্ষপথের নিচের দিক দিয়ে লক্ষ্যবস্তুর দিকে এগিয়ে যায়। চীন এই দুটি ধরনের সমন্বয়ে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়নে সফল হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।ড. লিওনির মতে, হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো হয়তো একাকী যুদ্ধের মোড় বদলে দিতে পারে না। তবে এর ব্যবহারে কোনো কোনো লক্ষ্যবস্তু হামলার উচ্চ ঝুঁকির মুখে পড়ে।হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো শব্দের পাঁচ গুণের চেয়ে বেশি গতিতে ছুটতে পারে। তবে আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের (আইসিবিএম) চেয়ে এর গতি কম। এরপরও হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র রাডারে শনাক্ত করা খুবই কঠিন। এ কারণে এগুলো অনেক আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে সহজেই ফাঁকি দিতে পারে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সাইবার হামলা
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য বলছে, চীন এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে ‘বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন’ সমরাস্ত্র তৈরির দিকে পুরোপুরি নজর দিচ্ছে। চীনের একাডেমি অব মিলিটারি সায়েন্সও এই প্রক্রিয়ায় এগোতে সায় দিয়েছে।
চীন যে এরই মধ্যে মিলিটারি রোবোটিকস ও মিসাইল গাইডেন্স সিস্টেমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করছে—এমন ইঙ্গিত নানা প্রতিবেদনে পাওয়া গেছে। চালকবিহীন উড়োজাহাজ ও নৌযানেও এ প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে বলে মনে করা হয়।
চীন-তাইওয়ান বৈরিতার শুরু যেখান থেকে
এ ছাড়া চীন বিদেশে বড় পরিসরে সাইবার হামলাও চালিয়েছে বলে সম্প্রতি বিশেষজ্ঞদের একটি বিশ্লেষণে উল্লেখ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন গত জুলাইয়ে অভিযোগ করে, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটের এক্সচেঞ্জ সার্ভারে সাইবার হামলার পেছনে চীনের হাত রয়েছে।
ধারণা করা হয়, ওই সাইবার হামলায় সারা বিশ্বের অন্তত ৩০ হাজার সংস্থা আক্রান্ত হয়েছিল। ব্যক্তিগত তথ্য ও মেধাস্বত্ব হাতিয়ে নেওয়াসহ বড় ধরনের গুপ্তচরবৃত্তির লক্ষ্যে ওই হামলা চালানো হয়েছিল।
অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
সব মিলিয়ে প্রশ্ন উঠছে, চীন কি সংঘাত থেকে দূরে থাকার নীতি এড়িয়ে একটি হুমকি হয়ে উঠছে? লন্ডনের কিংস কলেজের অধ্যাপক ড. জেনো লিওনির মতে, এখন পর্যন্ত ‘লড়াই ছাড়াই জয়ী হওয়ার’ নীতিতে হাঁটছে চীন। ভবিষ্যতে এ নীতি বদলাতে পারে দেশটি। নৌ শক্তিকে পুরোপুরি সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সমরাস্ত্রে সজ্জিত করতে পারলে তাদের ওই নীতিগত অবস্থানের বদল ঘটতে পারে।
তবে এ নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির সাবেক কর্মকর্তা ঝউ বো। তাঁর ভাষ্য, চীনের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি নিয়ে পশ্চিমাদের ভয় একেবারেই ভিত্তিহীন। যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্বের অন্য দেশগুলোর ওপর ছড়ি ঘোরানোর কোনো শখ বেইজিংয়ের নেই। এমনকি চীন যদি এক দিন আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তারপরও দেশটি তার নীতি মাথায় রেখে চলবে।