বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের ক্ষমতা ও সুযোগ কমছে

প্রণীত খসড়ায় কী আছে

১৯৯২ সালে করা আইনের আলোকে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন শুরু হয়। এরপর ২০১০ সালে আইনটি সংশোধন করে নতুন আইন করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এখন আবারও আইনটি সংশোধন করা হচ্ছে। আইনের খসড়ার সঙ্গে একটি খসড়া সংবিধিও করে দেওয়া হয়েছে, যাতে কাজগুলো কী হবে, তা বিস্তারিতভাবে বলে দেওয়া হয়েছে।বোর্ড অব ট্রাস্টিজের ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা সীমিত করার প্রস্তাব করে খসড়ায় বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজে কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষাবিদ থাকতে হবে। ইউজিসির সুপারিশ ও সরকারের অনুমোদন ছাড়া বোর্ড অব ট্রাস্টিজ কোনো রকম পরিবর্তন করা যাবে না। প্রয়োজন হলে ইউজিসি বা সরকার সাময়িকভাবে একজন পর্যবেক্ষক মনোনয়ন দিতে পারবে। বিদ্যমান আইনে সর্বোচ্চ ২১ জন ও কমপক্ষে ৯ সদস্যের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ থাকতে হয়। এখানে আলাদা করে শিক্ষাবিদের কথা বলা নেই।সংশোধিত আইন বাস্তবায়িত হলে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের পর শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর আগেই কমপক্ষে এক লাখ বর্গফুট আয়তনের নিজস্ব বা সাময়িক সময়ের জন্য ভাড়া করা ভবন থাকতে হবে। বর্তমান আইনে কমপক্ষে ২৫ হাজার বর্গফুট আয়তনের ভবন হলে হয়।সংরক্ষিত তহবিলের পরিমাণ যেমন বাড়ানো হচ্ছে, তেমনি স্থায়ী অনুমোদনের জন্য এলাকাভেদে জায়গার পরিমাণও বাড়ানো হচ্ছে। বিদ্যমান আইনে সনদের জন্য (স্থায়ী অনুমোদন) ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগর এলাকায় অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে কমপক্ষে এক একর পরিমাণ এবং অন্যান্য এলাকার জন্য কমপক্ষে দুই একর জমি থাকতে হয়। কিন্তু প্রস্তাবিত আইনে তা বাড়িয়ে কমপক্ষে পাঁচ একর করা হয়েছে। অবশ্য ইতিমধ্যে অনুমোদন পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমির এই বিষয় প্রযোজ্য হবে না। এটি মূলত নতুন করে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পেলে সে ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।অন্যদিকে সংশোধিত আইনের খসড়া অনুযায়ী, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে সংরক্ষিত তহবিল হিসাবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগর এলাকার জন্য কমপক্ষে আট কোটি এবং অন্যান্য এলাকার জন্য কমপক্ষে তিন কোটি টাকা ব্যাংকে জমা রাখতে হবে। বর্তমানে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগর এলাকার জন্য কমপক্ষে পাঁচ কোটি এবং অন্য মহানগরগুলোর জন্য কমপক্ষে তিন কোটি আর অন্যান্য এলাকার জন্য দেড় কোটি টাকা রাখতে হয়।

কমছে ট্রাস্টিদের ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা

এখন বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্যদের কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালকসহ (অর্থ) বিভিন্ন পদেও চাকরি করেন। যেখান থেকে তাঁরা মাসে বেতন-ভাতা নিচ্ছেন। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় দামি গাড়ি হাঁকানো, সম্মানীর নামে প্রচুর টাকা নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। এখানে রাশ টানতে চাইছে সরকার।প্রণীত খসড়ায় বলা হয়েছে, বোর্ড অব ট্রাস্টিজের কোনো সদস্য ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো লাভজনক পদে বসতে পারবেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সভায় বা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য কোনো আর্থিক সুবিধা (সম্মানী বা অ্যালাউন্স, গাড়ির সুবিধা ইত্যাদি) গ্রহণ করতে পারবেন না। এমনকি তাঁদের পরিবারের সদস্যরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের লাভজনক পদে বসতে পারবেন না।অন্যদিকে অর্থ কমিটির সভাপতি হবেন উপাচার্য। আর অন্য সদস্যদের পাশাপাশি বোর্ড অব ট্রাস্টিজের মনোনীত একজন প্রতিনিধি থাকবেন। বর্তমানে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের মনোনীত তিনজন সদস্য এই কমিটিতে থাকেন, যার মধ্যে একজন সভাপতি হন।

তিন শীর্ষ পদে নিয়োগের যোগ্যতা

আচার্য হিসেবে রাষ্ট্রপতি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সহ–উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ দেন। সংশোধিত আইনের খসড়া অনুযায়ী, উপাচার্য নিয়োগের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি বা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে যেকোনো একটি স্তরে প্রথম শ্রেণি বা সিজিপিএ–৪–এর মধ্যে ৩ দশমিক ৫ থাকতে হবে। পাশাপাশি স্বীকৃতি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে কমপক্ষে ২০ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।বর্তমানে উপাচার্য নিয়োগের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কমপক্ষে ১০ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাসহ গবেষণা বা প্রশাসনিক কাজে মোট ২০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ প্রক্রিয়াতেও সংশোধনী আনা হচ্ছে।এসব পদে মেয়াদ শেষ হওয়ার কমপক্ষে চার মাস আগেই নিয়োগের জন্য প্রস্তাব পাঠাতে হবে। বর্তমানে মেয়াদ শেষ হওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে বা পরেও এই পদে নিয়োগের প্রস্তাব পাঠানো হয়। ফলে জটিলতা হয়, এমনকি অনেক সময় পদ শূন্য থাকে।

শিক্ষার্থী ফি নির্ধারণে লাগবে ইউজিসির অনুমোদন

বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফি ‘ইচ্ছামতো আদায়সহ’ নানা রকম অভিযোগ আছে। খসড়া প্রস্তাব করা হয়েছে, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার মানদণ্ডে সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষার্থী ফি ঠিক করে ইউজিসির অনুমোদন নিতে হবে। এটি আবার সরকারকে (শিক্ষা মন্ত্রণালয়) জানাতে হবে। এর কোনো পরিবর্তন করতে চাইলেও ইউজিসির অনুমোদন লাগবে।এমনকি কোনো শিক্ষার্থী কোনো প্রোগ্রামে ভর্তির সময় যে ফি কাঠামো দেখে ভর্তি হবেন, তা প্রোগ্রাম শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাড়ানো যাবে না বলে খসড়ায় বলা হয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ফি ঠিক করে ইউজিসিকে কেবল অবহিত করে থাকে।এ ছাড়া সংশোধিত আইনের খসড়ায় এখনকার আইনের শাস্তিগুলোর পাশাপাশি নতুন একটি উপধারা যুক্ত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘আইনে এমন কোনো বিধান যেগুলোর বিষয়ে পৃথক কোনো জরিমানা বা অর্থদণ্ডের বিধান নেই, সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা ব্যক্তি লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা যাবে।’

‘ভালো-মন্দ দুটি দিকই আছে’

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, যেভাবে খসড়াটি করা হয়েছে, সেটি বাস্তবায়িত হলে নতুন করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা কঠিন হবে। একই সঙ্গে বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনা করতেও হিমশিম খেতে হবে।ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির প্রধান উপদেষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, এখানে ভালো-মন্দ দুটি দিকই আছে। জমির পরিমাণ এবং সংরক্ষিত তহবিলে কত টাকা আছে, সেটি অত গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো যারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করছেন, তাঁদের উচ্চশিক্ষায় অবদান রাখার মতো যোগ্যতা ও মানসিকতা আছে কি না।তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর বলেন, একটি বোর্ডের সভায় নির্ধারিত পরিমাণ সম্মানী নিলে দোষের কী? কিন্তু বোর্ডের সদস্যরা বেতন নিয়ে কাজ করতে পারবে না এটি ভালো বিধান। কিন্তু সবকিছু যদি সরকার নির্ধারণ করে দেয় তাহলে আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কেন?জানতে চাইলে ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সময়ের সঙ্গে মিল রেখে আইনের পরিবর্তন-পরিমার্জন হতেই পারে। তবে সেটি যেন সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের মতামতের ভিত্তিতেই করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *