দিনে প্রায় ৮০-৯০ হাজার, মাসে প্রায় ৩০লক্ষ টাকা চাঁদা আদায়ের অভিযোগ
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
নাটোর জেলা শহর থেকে প্রত্যন্ত ইউনিয়ন পর্যন্ত চলছে চাঁদাবাজি। বাস, ট্রাক ও সিএনজি থেকে চাঁদা তুলছে স্থানীয় মালিক সমিতি, শ্রমিক ইউনিয়নসহ বিভিন্ন গোষ্ঠী। সরকারী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে যাত্রীবাহী বাস থামিয়ে নাটোর-ঢাকা মহাসড়কের হরিশপুর বাইপাস টার্মিনাল ও মাদ্রাসা মোড় বাস টার্মিনাল এলাকায় বাস-মিনিবাস মালিক সমিতি ও পরিবহণ শ্রমিক ইউনিয়নের নামে চলছে দিনে দুপুরে প্রকাশ্য চাঁদাবাজি। ফলে প্রতিদিনই লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে মালিক সমিতির কতিপয় নেতাকর্মী।
জেলা সদর থেকে উপজেলা এমনকি ইউনিয়নের কেন্দ্রস্থল পর্যন্ত চলছে চাঁদার হাতবদল। নানা অজুহাতে তোলা হচ্ছে এসব অঘোষিত চাঁদা। না দিলে গাড়ির চাকা ঘোরে না। চাঁদাই এখন সড়ক পরিবহনের প্রধান চালিকাশক্তি। প্রতিটি বাস টার্মিনাল, জেলা সড়কের প্রবেশ ও বহির্গমন পথে নিয়মিত চাঁদার টাকা দিতে হয়। রোববার (১১ সেপ্টেম্বর) সকালে সরেজমিনে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নাটোর-ঢাকা মহাসড়কে হরিশপুর বাইপাস বাস টার্মিনাল এলাকায় বাস-মিনিবাস মালিক সমিতিরি নিয়োগকৃত ব্যক্তিরা পর্যায়ক্রমে নাটোর থেকে ঢাকাগামী যাত্রীবাহী বাস থামিয়ে প্রকাশ্যে করছে চাঁদাবাজি। এছাড়াও মাদ্রাসা মোড় ও ষ্টেশন বাজার এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সিএনজি-অটোরিক্সা মালিক সমিতির নামেও চলছে চাঁদাবাজি।
টার্মিনাল সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে নাটোর থেকে ঢাকা, বগুড়া, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুর, সিরাজগঞ্জ, পাবনাসহ পাশ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকার কয়েকটি রুটে প্রায় পাঁচ শতাধিকেরও বেশি বাস-মিনিবাস চলাচল করছে। এসব রুটের যানবাহন থেকে পরিবহণ মালিক সমিতি, শ্রমিক ইউনিয়ন ও শ্রমিক ফেডারেশনের নির্ধারিত চাঁদা ছাড়াও অতিরিক্ত চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। প্রতিটি গাড়ি থেকে ২০০-২৫০ টাকা হারে অতিরিক্ত চাঁদা উত্তোলন করা হচ্ছে। যা দিনে প্রায় ৮০-৯০ হাজার টাকারও বেশি। মাসে চাঁদা উঠছে প্রায় ৩০লক্ষ টাকা।
নাটোরের টার্মিনালগুলো থেকে ছেড়ে যাওয়া একাধিক রুটের বাস মালিক ও চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরিবহন মালিকদের চাঁদা দিতে হচ্ছে পদে পদে। টার্মিনাল থেকে গাড়ি ছাড়ার আগেই দিতে হচ্ছে জিপির নামে মোটা অঙ্কের টাকা। জিপি ছাড়াও টার্মিনাল থেকে গাড়ি বের হওয়ার সময় যানজট নিয়ন্ত্রণে লোকজনকে দিতে হয় গাড়িপ্রতি ২০ টাকা, লাইনম্যানকে ১০ টাকা।
বাস-মিনিবাস ব্যবসায় জড়িত একজন বলেন, আমরা পরিবহন ব্যবসায় ভ্যাট-ট্যাক্সের চাপে অস্থির। তার ওপর এই চাঁদাবাজি। এভাবেই যদি সব টাকা চলে যায় তাহলে এখানে কে বিনিয়োগ করতে আসবে? তার মধ্যে একেকটা রুটে ঢুকতে গেলে লাখ লাখ টাকা চাঁদা দিতে হয়। মোটা অঙ্কের চাঁদা দেয়া ছাড়া কোন রুটে ঢোকা যায় না। নাটোর থেকে ভালো ভালো কিছু রুট গুলো মালিক সমিতি নেতাদের জিম্মায়। তিনি বলেন, যারা জীবনে গাড়ি চালাননি তারাই এখন শ্রমিক নেতা। চারজন মিলে এক বাসের মালিক। তারাই এখন মালিক সমিতির নেতা।
নাটোর জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির নব-নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক মোঃ মজিবুর রহমান বলেন এ ধরনের কোন কর্মকান্ড বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির আওতায় হয় না।
এছাড়াও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিবহণ সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি বলেন নাটোর বাস-টার্মিনাল এলাকায় দিনের আলোতে পৌরসভার ইজারাদারদের টাকা, মালিক সমিতির টাকা প্রকাশ্যে উত্তোলন করলেও রাত ১১টার পরে পরিবহণ শ্রমিক ইউনিয়নের নামে প্রতি গাড়ি থেকে ১৫০-২০০ টাকা উত্তোলন করা হচ্ছে।
পরিবহণ শ্রমিক ইউনিয়নের চাঁদাবাজির বিষয়ে, জেলা পরিবহণ শ্রমিক ইউনিয়নের নব-নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম কালিয়া জানান, এ বিষয়ে আমি অবগত নই, আমি কিছু জানিনা।
নাটোর শহরের মাদ্রাসা মোড় এলাকা থেকে সিএনজি-অটোরিক্সা মালিক সমিতির নামেও ব্যাপক হারে চলছে চাঁদাবাজি। ফলে প্রভাব পড়ছে সাধারণ যাত্রীদের ওপর। গত ২ দিন এই বিষয়ে অনুসন্ধান করে একাধিক অটোরিক্সা চালক জানান, নাটোর মাদ্রাসা মোড় এলাকার ভবানীগঞ্জ মোড় থেকে কালীগঞ্জ, ভাঙ্গাডাঙ্গাল, হাতিয়ান্দহ, পাটুল-খাজুরিয়া এবং নাটোর ষ্টেশন বাজার এলাকা থেকে নলডাঙ্গা, মাধনগর, আত্রাই, বীরকুৎসা রুটে সিএনজি অটোরিক্সা চলাচল করে। প্রতিনিয়ত তাদের চাঁদার টাকা গুনতে হয়। একেকজন সিএনজি চালক প্রতি ট্রিপে অন্তত ৩০ টাকা চাঁদা দিতে হয় লাইনম্যানকে এবং মাসিক ৩০০ টাকা করে দিতে সিএনজি মালিক সমিতিকে। এভাবে প্রতিটি রুটেই একই হারে চাঁদা প্রদান করতে হয় চালকদের। কি কারণে চাঁদা দিচ্ছেন তারা তা জানেন না।
এ বিষয়ে নাটোর জেলা সিএনজি মালিক সমিতির নব-নির্বাচিত সভাপতি মোঃ হুসেন আলী সরদার জানান আমরা শ্রম দপ্তরের আওতাভূক্ত সংগঠণ, আমরা যেই টাকা উত্তোলন করছি, তা আমাদের গঠণতন্ত্র মোতাবেক।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত ২০ ফেব্রুয়ারী নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন নাটোর-০৪ আসনের সংসদ সদস্য অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন নাটোর সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম রমজান। তারা নির্বাচিত হওয়ার পর-পরই পরিবহণ সংশ্লিষ্ট প্রতিটি সেক্টরে দ্রুত নির্বাচন দেন। তাদের নেতৃত্বেই নাটোর জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতি, নাটোর জেলা সিএনজি-অটোরিক্সা সমিতি ও নাটোর জেলা পরিবহণ শ্রমিক ইউনিয়নে নতুন কমিটি গঠন করা হয়। এর পর থেকেই বেপরোয়াভাবে ঘোষিত এবং অঘোষিতভাবে চাঁদা উত্তোলন করা হচ্ছে।