‘দুর্বল তদন্তে’ পার পাচ্ছে অপরাধীরা

দেশে মানবপাচারে জড়িত খুব কম ব্যক্তিরই সাজা হচ্ছে। গত মে মাস পর্যন্ত দেশে পাঁচ হাজার ৭৪০টি মানবপাচার মামলা ঝুলে আছে। যত মামলা হচ্ছে, তার মাত্র ৪ শতাংশ বিচারে নিষ্পত্তি হচ্ছে। মাত্র ১৪ শতাংশ আসামির সাজা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, তদন্তের দুর্বলতার কারণেই আসামিদের বিচারের মুখোমুখি করা যাচ্ছে না। পাচারকারীচক্রের হোতারাও ধরা পড়ছে না।

যারা গ্রেপ্তার হচ্ছে, তাদের বেশির ভাগই দালাল ও প্রধান আসামিদের আত্মীয়-স্বজন। বিদেশে থাকা পাচারকারীদের গ্রেপ্তারে নেই তেমন উদ্যোগ। এ ছাড়া প্রভাবশালী আসামিদের ভয়ে মামলায় সমঝোতা করছে ভুক্তভোগীরা। সাক্ষীরাও আদালতে হাজির হতে চায় না। ভুক্তভোগী, এনজিওকর্মী, আইনজীবী, তদন্তকারীরাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এসব তথ্য জানান।

গত মঙ্গলবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর ২০২২ সালের মানবপাচারবিরোধী (টিআইপি)  প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার মানবপাচার ঠেকাতে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নিয়েছে। তবে দেশটির মানবপাচার নির্মূল প্রচেষ্টা ন্যূনতম মান পূরণ করতে পারেনি।

মানবপাচার মামলার তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দেয় পুলিশ সদর দপ্তরের স্পেশাল ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট শাখা। মন্ত্রণালয়ে দেওয়া সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের মে পর্যন্ত ৭১১টি মামলা তদন্তাধীন। আর দেশের বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন পাঁচ হাজার ২৯টি মামলা। চলতি বছরের পাঁচ মাসে একটি মানবপাচার মামলায়ও বিচার নিষ্পত্তি হয়নি। এ সময় ২৫১টি নতুন মামলা করা হয়েছে। অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে ৫৩টি মামলায়। আর তিনটি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।

তথ্য মতে, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তদন্তাধীন মামলা ছিল ৬৯৭টি এবং বিচারাধীন ছিল চার হাজার ৮০৫টি। এ বছর ৫৫৪টি মামলা করা হয়েছে। এ সময় ৩৬৬টি মামলার অভিযোগপত্র এবং ৪০টি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। গেল বছর মাত্র দুটি মামলার বিচার করা হয়েছে, যেখানে পাঁচজন আসামি সবাই খালাস পেয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে ৫৩৩টি নতুন মামলা করা হয়। বছর শেষে ৫২৭টি মামলা তদন্তাধীন এবং চার হাজার ৩৫৯টি মামলা বিচারাধীন ছিল। ২০১২ সালে বিচারে ১৪টি মামলার নিষ্পত্তি হয়। এর মধ্যে মাত্র একটি মামলায় আসামির কারাদণ্ড হয়। বাকি ১৩টি মামলায় ৪৩ আসামি বিচারে খালাস পেয়ে যায়।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ৪৪৫টি মামলা তদন্তাধীন ও তিন হাজার ৯৬২টি মামলা বিচারাধীন ছিল। ওই বছর নতুন মামলা হয়েছে ৬৮৫টি। এর মধ্যে ৯৬টির অভিযোগপত্র এবং ৭৪টির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।

সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঝুলছে অন্তত ১৪৫টি মামলা। ৪৭৮টি মামলা আছে পাঁচ বছরেরও বেশি সময়। তদন্ত চলাকালে এবং বিচারের সময় সাক্ষীদের পাওয়া যায় না। দালাল সিন্ডিকেট সাক্ষীদের ভয় দেখায়। আবার টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে ফেলে।

এনজিও ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশেমানবপাচারের ছয় হাজার ১৩৪টি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৩৩টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। ৩৩টি মামলায় ৫৪ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। ২০০ মামলায়ই আসামি খালাস পেয়েছে। ২০২০ সাল পর্যন্ত বিচারাধীন ছিল বাকি পাঁচ হাজার ৯০১টি মামলা। হিসাবমতে, প্রায় ১৪ শতাংশ মামলায় আসামির সাজা হয়েছে। বাকি প্রায় ৮৬ শতাংশ বিচারে আসামি খালাস পেয়েছে।

২০১২ সালের ‘মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে’ সংঘবদ্ধভাবে মানবপাচারের জন্য মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও সর্বনিম্ন সাত বছরের কারাদণ্ড এবং অন্যূন পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান আছে। আইনে আলাদা করে বিশেষ আদালত বা ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান থাকলেও আট বছর পর ২০২০ সালে তা গঠন করা হয়।

ঢাকার মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (ভারপ্রাপ্ত পাবলিক প্রসিকিউটর) সাজ্জাদুল হক শিহাব বলেন, ‘আদালতের কার্যক্রম শুরুর পর অনেক মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। তবে সাজার পরিমাণ খুবই কম। এর প্রধান কারণ সাক্ষী আসে না। এ ছাড়া দুর্বল তদন্ত অন্যতম কারণ। সাক্ষীরা কোর্টে এসে আপসের কথা বলে। কোর্টে এসে মামলায় উল্টো সাক্ষ্য দেয়। এ জন্য তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার সময় আরো বেশি সতর্কতা প্রয়োজন। ’

সিআইডিতে মানবপাচারের মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ও অ্যাডিশনাল ডিআইজি মুহাম্মদ সাইদুর রহমান বলেন, ‘প্রতারণার শিকার হয়ে দেশে টাকা ফেরত পেলে অনেকে আর মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করে না। কিছু ব্যক্তি মামলা করলেও পাচারকারীদের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা দেয় না। ’

হোতাদের পর্যন্ত যাচ্ছে না তদন্ত

জানা গেছে, মানবপাচারের আলোচিত মামলায়ও মূল পাচারকারীদের পর্যন্ত পৌঁছায় না তদন্ত কার্যক্রম। ২০২০ সালের ২৭ মে লিবিয়ার মিজদায় ২৬ বাংলাদেশি হত্যার অভিযোগে ২৫টি মামলার তদন্ত করে প্রতিবেদন দিয়েছে সিআইডি। গ্রেপ্তারকৃত ৪২ আসামির স্বীকারোক্তি ও জীবিত ফিরে আসা ৯ ভুক্তভোগীর জবানবন্দিতে শনাক্ত হওয়া ছয়জনকে ধরতে ২০২০ সালের নভেম্বরে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করা হয়। তাদের একজন মাদারীপুরের শাহাদাত হোসেন গত বছরের ১৩ জানুয়ারি লিবিয়া থেকে ফিরে ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দর গ্রেপ্তার হয়। কিশোরগঞ্জের ভৈরবের লক্ষ্মীপুরের জাফর ইকবালকে ইতালির কোসেঞ্জা থেকে সে দেশের পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু হলেও সে দেশের আইনে হস্তান্তর জটিল।

সূত্র জানায়, তালিকায় থাকা ভৈরবের শম্ভুপুরের স্বপন এবং শিমুলকান্দির মিন্টু মিয়া সর্বশেষ লিবিয়ায় ছিল। তানজিরুল ওরফে তামজিদ সর্বশেষ ছিল ইতালিতে। রেড নোটিশের আরেকজন মাদারীপুর সদরের নজরুল ইসলাম মোল্লার অবস্থান জানা যায়নি। নোটিশের বাইরে আছে লিবিয়ার বেনগাজীতে চক্রের অন্যতম সদস্য আব্দুল্লাহ। দুবাইয়ে অবস্থানরত আফ্রীন আহমেদ আরেকটি চক্রের হোতা। লিবিয়ায় সজীব, মানিক ও জাফর বিদেশগামীদের সীমান্তে নেয়। দুবাইয়ে অবস্থান করছে এই চক্রের গাজী, কাজী ও বাবুল। এসব চক্রে সরাসরি জড়িত কয়েকজন দেশেই পালিয়ে আছে।

গত বছর রাজধানীর মিরপুরের কালশীর ঝিলপার বস্তি থেকে এক তরুণীকে ভারতে পাচারের পর তাঁর মা সেখানে গিয়ে মেয়েকে ফিরিয়ে আনার ঘটনা ব্যাপক আলোচিত হয়। এ ঘটনায় গত বছরের ১৬ আগস্ট কালু, সোহাগ ওরফে নাগিন সোহাগ ও বিল্লাল হোসেন নামের তিনজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এর আগে ভারতে পাচারের শিকার এক বাংলাদেশি তরুণীকে নির্যাতনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ওই ভিডিওর সূত্র ধরে গত বছরের ২৭ মে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে বেঙ্গালুরুর পুলিশ। ঘটনায় জড়িত টিকটক হৃদয়ের সহযোগীদের দেশে গ্রেপ্তারের পর সম্প্রতি তাকেও ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

র‌্যাব ও পুলিশের তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, চাকরির প্রলোভনে ভারতে নারী পাচারের সঙ্গে দুই দেশের সাতটি চক্র জড়িত। সাতক্ষীরা, নড়াইল, যশোর, চুয়াডাঙ্গাসহ সীমান্তে অর্ধশত শেল্টার হোম তৈরি করেছে এসব চক্র। নারী পাচারে সমন্বয় করছেন নড়াইলের চান মিয়া বিশ্বাস ওরফে সবুজ (৩০) নামের এক যুবক। যশোরের শার্শার বাসিন্দা আল আমিন হোসেন, বেনাপোলের ইস্রাফিল হোসেন খোকন, সাতক্ষীরার দেবহাটায় বিল্লালসহ কয়েকজন এই পাচার সিন্ডিকেটের সদস্য। চক্রের হোতাদের এখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি।

সিআইডির অ্যাডিশনাল ডিআইজি মুহাম্মদ সাইদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের যতটুকু যাওয়ার সুযোগ আছে সেই অনুযায়ী তদন্ত করে চক্র শনাক্ত করা হচ্ছে। রুটে এই পাচার বন্ধ করতে হলে সচেতনতা বাড়াতে হবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে সংশ্লিষ্ট দেশের সহায়তা চাওয়া যেতে পারে। ’

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘দালালরা আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্রের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। চক্রের হোতারা দেশের বাইরে। দেশে নজরদারি করে চক্রের সদস্যদের আমরা ধরছি। ’

ভুক্তভোগীদের সুরক্ষার তাগিদ

গত ২০ জুন ঢাকায় সিআইডি কার্যালয়ে এক কর্মশালায় বক্তারা পাচার নিয়ন্ত্রণে তদন্তপ্রক্রিয়াকে উন্নত করার পাশাপাশি ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা দেওয়া কথা বলেন। কর্মশালায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ইশরাত শামীম, তিনি একটি সংস্থার জন্য সীমান্তে মানবপাচার নিয়ে গবেষণামূলক কাজ করেছেন।

অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ইশরাত শামীম বলেন, এক ভুক্তভোগীকে উদ্ধারে সহায়তা করার পর দিনাজপুরের এক ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে উল্টো মামলা করে দালালরা। এসব কারণে ভুক্তভোগীদের উদ্ধারেও সহায়তা মেলে না। অভিযোগ পেলে পুলিশের এসব বিষয় যাচাই করা উচিত। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো আবার ট্রাভেল এজেন্সি পরিচালনা করে। ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে অনেকে পাচারের শিকার হয়।

ওই অনুষ্ঠানে সিআইডিপ্রধান ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘তথ্য বা ডকুমেন্টস ছাড়া কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা খুব কঠিন। বাদী ঠিক থাকে না, আপস করে ফেলে। কিন্তু আমরা যদি দেখি, এখানে একটি চক্র কাজ করেছে, তাহলে সেই চক্রকে ছাড় দেওয়া হয় না। মামলা করাই হয়। ’

জানতে চাইলে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওমর ফারুক বলেন, ‘মানবপাচার মূলত আর্থিক সুবিধার জন্য সংঘবদ্ধ অপরাধ। এই অপরাধীরা ক্ষমতা ও টাকায় শক্তিশালী। তাদের প্রভাবের কারণে ভুক্তভোগীরা অসহায় হয়ে পড়ে। এ জন্য ভুক্তভোগীদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। তদন্ত দুর্বল থাকার কারণেই বিচারে পার পাচ্ছে অপরাধীরা। বিচার না হওয়ার কারণে মানবপাচার কমছে না। ’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রসিকিউশনের দুর্বলতার কারণে মানবপাচার মামলাগুলোর নিষ্পত্তি হচ্ছে না। নামমাত্র যে কটির বিচার হয়েছে তাতে দুর্বলতার কারণে আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে। আমি মনে করি, দুদকের মতো মানবপাচার ট্রাইব্যুনালেও আলাদা একটি শক্তিশালী প্রসিকিউশন সেল থাকা উচিত। পাবলিক প্রসিকিউশন দিয়ে হবে না। আইনজীবীরা দেখে অনুমোদন দিলে চার্জশিটে আর দুর্বলতা থাকবে না। ’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *