ঝড় তীব্র না হলেও বড় ক্ষতির ঝুঁকি উপকূলে

বছর ঘুরলেও ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের ধাক্কা এখনও সামাল দিতে পারেননি উপকূলবাসী। দুর্যোগ আসে-যায়, সাগরপাড়ের অসহায় মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই যেন থামতেই চায় না। প্রকৃতির রোষে বারবার ‘উদ্বাস্তু’ হওয়াই যেন নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে উপকূলবাসীর। গত বছরের মে মাসে ইয়াসের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড হয়েছিল সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা। বাঁধ ভেঙে দক্ষিণাঞ্চলে ক্ষেতের ফসল-বাড়িঘর ডুবেছিল অথৈ নোনা জলে। ফের সব হারানোর ভয়। উপকূলজুড়ে চেপে বসেছে ‘আসানি’ আতঙ্ক।
আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে এখন পর্যন্ত চট্টগ্রাম, মোংলা, পায়রাবন্দর ও কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।

আবহাওয়াবিদরা আশার পাশাপাশি শোনাচ্ছেন শঙ্কার কথাও। তারা বলছেন, আসানির তেজ ধীরে ধীরে কমছে। বর্তমান গতিবিধি অনুসারে ঝড়টি আজ মঙ্গলবারের মধ্যে ভারতের অল্প্রব্দপ্রদেশ-ওডিশা উপকূলের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। স্থলভাগে আঘাত হানার আশঙ্কা খুবই কম। ক্রমাগত শক্তি হারিয়ে ঝড়টি আগামী দু’দিনের মধ্যে নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে। তবে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ভারি বৃষ্টিপাত আর জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে যেতে পারে উপকূলের বাড়িঘর। বরিশাল ও নোয়াখালী অঞ্চলে স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচ-সাত ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। কক্সবাজার এলাকায় ধসে পড়তে পারে পাহাড়।

বদলাচ্ছে গতিপথ, প্রভাব পড়বে উপকূলে :যতই উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড়, ততই সমুদ্রের চেহারা বদলে যাচ্ছে। আবহাওয়াবিদরা মনে করছেন, ঘূর্ণিঝড় কোনো উপকূলে আছড়ে না পড়লেও সমুদ্র ফুঁসে উঠবে। তার জেরে হতে পারে জলোচ্ছ্বাস।

এখনও বাংলাদেশ উপকূল থেকে ‘আসানি’ হাজার কিলোমিটার দূরে থাকলেও ঝড়ের কেন্দ্র থেকে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ ভেসে এসেছে। এর প্রভাবে গতকাল সোমবার বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রামসহ উপকূলীয় এলাকাগুলোতে বৃষ্টি হয়েছে। সাগর রয়েছে উত্তাল। বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে সৈকত তীরে। শেষ পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হানবে কিনা, তা এখনও নিশ্চিত করতে পারেনি আবহাওয়া অধিদপ্তর।

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ঘূর্ণিঝড়টি খানিকটা উত্তর-পশ্চিম দিকে সরে গিয়ে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২০ কিলোমিটার গতিতে এগোচ্ছে। এখন পর্যন্ত এর গতিমুখ ভারতের অল্প্রব্দ উপকূলের দিকে আছে। তবে আজ মঙ্গলবার তা আরও খানিকটা দিক বদলাতে পারে। শেষ পর্যন্ত ঝড়টি কোন দিক ধরে উপকূলের দিকে এগোবে, তা আজ দুপুর নাগাদ বলা যাবে। এমনকি ঘূর্ণিঝড় দুর্বল হয়ে বঙ্গোপসাগরেই বিলীন হয়ে যেতে পারে বলেও মনে করছে ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ছানাউল হক ম ল বলেন, ঝড়টি বাংলাদেশ বা ভারত যে দেশের দিকে মুখ করে এগিয়ে আসুক না কেন, তা কিছুটা দুর্বল হয়ে যেতে পারে।

কানাডার সাসকাচুয়ান ইউনিভার্সিটির আবহাওয়া ও জলবায়ু গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, আসানি ওডিশা উপকূল পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড় হিসেবে থাকবে। এর পর গতি কমে এটি নিম্নচাপ কিংবা লঘুচাপে পরিণত হতে পারে। আগামী শুক্রবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত এটি ওডিশায় অবস্থান করতে পারে। এরপর সাধারণ লঘুচাপ আকারে এটি বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের দিকে এগোতে থাকবে। বৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে ধুঁকতে পারে উপকূল। ১৪ মে পূর্ণিমা। পূর্ণিমা ও ঘূর্ণিঝড়ের মিলনে জোয়ারের উচ্চতা বেশি হবে।

উঁচু জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলার প্রস্তুতি নেই সুন্দরবনে :বন বিভাগ জানিয়েছে, নিম্নচাপ ও অমাবস্যা-পূর্ণিমার প্রভাবে মাঝেমধ্যে অস্বাভাবিক জোয়ারে প্লাবিত হয় সুন্দরবন। ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসে গত বছরের ২৫ মে থেকে তিন দিন চার-পাঁচ ফুট উচ্চতার জোয়ারে তলিয়ে যায়। এর আগে ২০২০ সালের ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের সময়ও বনভূমি প্লাবিত হয়েছিল। এভাবে প্রতিবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আশ্রয়স্থল না থাকায় হুমকির মুখে পড়ে বন্যপ্রাণী।
এ ব্যাপারে সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, জলোচ্ছ্বাস ও উঁচু জোয়ারের সময় সুন্দরবনের ভেতরে বন্যপ্রাণীদের আশ্রয় নেওয়ার জন্য কোনো উঁচু জায়গা নেই। এতে মাটি দিয়ে উঁচু ঢিবি করা প্রয়োজন। এ ছাড়া লবণ পানি ঢোকা ঠেকাতে বনের মধ্যে থাকা পুকুরগুলোর পাড় উঁচু করা জরুরি। কয়েক বছর ধরে এ বিষয়গুলো বলা হলেও বন বিভাগ এ নিয়ে গড়িমসি করছে।

সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় বনের বিভিন্ন স্থানে ১২টি মাটির ঢিবি বা কেল্লা তৈরি করা হবে। এ ছাড়া পুকুরগুলোর পাড়ের উচ্চতাও বাড়ানো হচ্ছে।

বৃষ্টিতে কৃষি খাতে ক্ষতি, উপকূলে আতঙ্ক :ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বৃষ্টিতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় কৃষি খাতের ক্ষতি হয়েছে। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় রবিশস্য পানিতে তলিয়ে গেছে। ঝুঁকিতে রয়েছে কুয়াকাটা রক্ষা বেড়িবাঁধের ৪৮ নম্বর পোল্ডারের দুটি পয়েন্টসহ সমুদ্র মোহনা আন্ধারমানিকের তিন নদীর সংযোগস্থল নিজামপুর, কোমরপুর ও সুধীরপুর বেড়িবাঁধ।

বাগেরহাট সদর উপজেলার ডেমা ইউনিয়নের চাষি নাজমুল শেখ বলেন, ‘ঈদের আগের দিন থেকে অনেক বৃষ্টি ছিল। গত দুই-তিন দিন বৃষ্টি না থাকায় আমরা ধান কেটে মাঠে রেখেছিলাম। সেগুলো বাড়ি আনার আগেই সব শেষ হয়ে গেল।’ বৃষ্টির কারণে যশোরের কেশবপুরে পাকা ধান নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষক। তারা ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন। পিরোজপুরের নাজিরপুরে এ বছর বোরো ধানের বাম্পার ফলন হলেও ধান ঘরে তুলতে পারেননি অধিকাংশ কৃষক। কারও ধান মাঠে, আবার কারও ধান বাড়ির আঙিনায়।

পিরোজপুরের ইন্দুরকানীর কচা ও বলেশ্বর নদীর বেড়িবাঁধ না থাকায় আতঙ্কে রয়েছেন নদী তীরের বাসিন্দারা। শরণখোলার সুন্দরবন সংলগ্ন উত্তর সাউথখালী এলাকার মিজানুর রহমান বলেন, ‘সিডরে আপনজন হারিয়েছি, ঘরবাড়ি, জমিজমা হারিয়েছি। সিডরের পরে আইলা, নার্গিস, বুলবুল, আম্পান, ইয়াসসহ একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে মূল্যবান সম্পদও হারিয়েছি। এ বছর নাকি আবার আসানি আঘাত হানবে। কী হবে বুঝতে পারছি না।’
(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সমকালের সংশ্নিষ্ট ব্যুরো অফিস ও প্রতিনিধিরা)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *