গমের বাজারে বিপদ কেটে যাওয়ার ইঙ্গিত

রাশিয়া–ইউক্রেন চুক্তির পর সরকারের প্রচেষ্টায় দ্রুত আমদানির পথ খুলবে বলে আশা ব্যবসায়ীদের।

  • এক বছরে আটা-ময়দার দাম বেড়েছে ৫০ থেকে ৫৬ শতাংশ।
  • দেশে গমের ৬০ শতাংশ আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে।

 

তুরস্ক বলছে, এ চুক্তির ফলে শুধু ইউক্রেন নয়, কৃষ্ণসাগর দিয়ে রাশিয়ার খাদ্য রপ্তানিও সহজ হবে। এর চুক্তির ফলে ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে বাংলাদেশের গম আমদানির পথ খোলার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের গম আমদানির ৬০ শতাংশই আসে এ দুটি দেশ থেকে। দেশের অন্যতম গম আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নাবিল গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অনুপ কুমার সাহা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে, আমরা আশা করব সরকার কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি খাতে গম আমদানির পথ সুগম করবে।’ প্রসঙ্গত, দেশে গমের প্রায় ৯০ শতাংশই আসে বেসরকারি খাতের মাধ্যমে। বছরের এ সময়ে রাশিয়া, ইউক্রেনসহ কৃষ্ণসাগর অঞ্চল এবং ভারত, পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে নতুন গম ওঠে। বিশ্বের মোট গমের ৪০ শতাংশ ওই অঞ্চলে উৎপাদিত হয়। সেখানকার প্রধান কৃষি রপ্তানি পণ্য হচ্ছে গম। এর বাইরে ফ্রান্স, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশে বাকি গম উৎপাদিত হয়। কিন্তু এ দেশগুলোর গমের মান বেশ ভালো, দামও বেশি। মূলত মধ্যপ্রাচ্যের দেশসহ উন্নত দেশগুলো এসব দেশ থেকে গম কেনে। অন্য বছরগুলোতে এ সময়ে বাংলাদেশ ১০ থেকে ১৫ লাখ টন গম আমদানির প্রক্রিয়া শুরু করে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ পর্যন্ত মাত্র ২৭ হাজার ৮৮০ টন গম আমদানির ঋণপত্র চূড়ান্ত হয়েছে। ‘আমরা ইতিমধ্যে ভারতের বাইরে বিকল্প রাষ্ট্রগুলো থেকে গম আমদানির চেষ্টা করেছি। এরই মধ্যে বুলগেরিয়া, কানাডাসহ বেশ কিছু রাষ্ট্রের সঙ্গে এ নিয়ে কথা হয়েছে। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে গম রপ্তানির চুক্তি হওয়ার পর সেখান থেকে আনার ব্যাপারেও চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।’

মো. ইসমাইল হোসেন, খাদ্যসচিব

আটা-ময়দার দাম বেড়েছে ৫০ থেকে ৫৬ শতাংশ

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে গত এক বছরে দেশে আটা–ময়দার দাম ৫০ থেকে ৫৬ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। গত মে মাসে ভারত গম রপ্তানি বন্ধ করার পর গম ও চালের দাম প্রায় সমান হয়ে গেছে। বিশ্ববাজার থেকে বাংলাদেশের বাজারে এক কেজি গমের আমদানি খরচ ৩৮ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত হয়েছে। আর চালও আনতে হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। আমরা ইতিমধ্যে ভারতের বাইরে বিকল্প রাষ্ট্রগুলো থেকে গম আমদানির চেষ্টা করেছি। এরই মধ্যে বুলগেরিয়া, কানাডাসহ বেশ কিছু রাষ্ট্রের সঙ্গে এ নিয়ে কথা হয়েছে। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে গম রপ্তানির চুক্তি হওয়ার পর সেখান থেকে আনার ব্যাপারেও চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। খাদ্যসচিব মো. ইসমাইল হোসেন অন্যদিকে চলতি মাসের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএ থেকে প্রকাশ করা বৈশ্বিক দানাদার খাদ্যের বাজার পরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেশি দামের কারণে এ বছর বাংলাদেশের গম আমদানি ৭৫ লাখ টন থেকে কমে ৭০ লাখ টনে দাঁড়াতে পারে। সংস্থাটির হিসাবে, এ অর্থবছরে বাংলাদেশে চালের ভোগ প্রায় ৮ লাখ টন বেড়ে ৩ কোটি ৬৮ লাখ টন হতে পারে। গমের দাম বেড়ে যাওয়ায় চালের ওপরে এ চাপ বেড়েছে বলে সংস্থাটি মনে করছে। অন্যদিকে বিশ্ববাজারেও চালের দাম বাড়ছে। চালের আমদানির ওপর সরকার আমদানি শুল্ক কমানোর পরও আশানুরূপ আমদানি হচ্ছে না। খাদ্যসচিব মো. ইসমাইল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে ভারতের বাইরে বিকল্প রাষ্ট্রগুলো থেকে গম আমদানির চেষ্টা করেছি। এরই মধ্যে বুলগেরিয়া, কানাডাসহ বেশ কিছু রাষ্ট্রের সঙ্গে এ নিয়ে কথা হয়েছে। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে গম রপ্তানির চুক্তি হওয়ার পর সেখান থেকে আনার ব্যাপারেও চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।’

বরাদ্দ কমেছে ওএমএসে

খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশের গরিব মানুষের একটি বড় অংশ সরকারের খোলাবাজারে (ওএমএস) চাল–আটা বিক্রির ওপরে নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু এক মাস ধরে ওএমএসে চাল ও আটার দুটি প্রধান খাদ্যের বরাদ্দ কমানো হয়েছে। গত মে মাস পর্যন্ত ডিলারপ্রতি চাল দেওয়া হতো দুই টন করে। আর আটা দেওয়া হতো দেড় টন। চলতি মাস থেকে আটা দেওয়া হচ্ছে ৫০০ কেজি করে। বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে ওই আটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। আর সারা দিন ডিলারদের দোকানে ক্রেতারা আটা কিনতে ধরনা দিচ্ছেন। চালও দুপুরের মধ্যে শেষ হওয়ায় ওএমএসের মাধ্যমেও দরিদ্র মানুষ প্রয়োজনীয় খাদ্য কিনতে পারছে না। ওএমএস কার্যক্রমে প্রতি কেজি চাল ৩০ টাকা এবং আটা ১৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে প্রতি কেজি আটা ৪০ থেকে ৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫২ এবং সরু ৮০ টাকা কেজি দরে। অন্যদিকে গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে সরকারি গুদামে ১ লাখ ৬৪ হাজার টন গম রয়েছে। সাধারণত বছরের এই সময়টায় তিন থেকে চার লাখ টন গম মজুত থাকে। অন্যদিকে চালের মজুত অবশ্য বেশ ভালো—১৪ লাখ ২৪ হাজার টন। সরকার এবার ২ লাখ টন গম অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সংগ্রহের পরিকল্পনা নিয়েছিল। কিন্তু এ পর্যন্ত মাত্র ২০ মেট্রিক টন গম সংগ্রহ করা গেছে। আর চাল সংগ্রহ হয়েছে ৮ লাখ ৩৪ হাজার টন।

প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সাবেক কৃষিসচিব এ এম এম শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দৈনিক খাদ্যাভ্যাসে চালের পরই গমের স্থান। আর বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গমের বাজারে এ ধরনের অস্থিতিশীলতা প্রায়ই দেখা দেবে। তাই বাংলাদেশের উচিত বিশ্বের প্রধান গম রপ্তানিকারক দেশগুলোর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি ও আগাম গম কিনে রাখার ব্যবস্থা করা। সরকারকে উদ্যোগ নিয়ে বেসরকারি আমদানিকারকদের সঙ্গে এ নিয়ে কাজ করতে হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *