এবার রাজউক চেয়ারম্যান নিজেই ভবন পরিদর্শনে যাবেন

বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয়
সিদ্ধান্তটিকে সম্পর্কে নগর-পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরির উদ্দেশ্যে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তবে সিদ্ধান্তটি একদিক থেকে ভালো। কিন্তু ভবন পরিদর্শনের জন্য রাজউকের চেয়ারম্যান কতটা সময় পাবেন, সিদ্ধান্তটি কতটা কার্যকর হয়, তা দেখতে হবে।আকতার মাহমুদ বলেন, রাজউক এলাকায় সবচেয়ে বেশি নির্মিত হয় ৬ থেকে ৭ তলা ভবন। ২০ তলার ওপর ভবনের সংখ্যা খুবই কম। তাই শুধু সুউচ্চ ভবন নয়, অন্যান্য ভবনও দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে রাজউকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরিদর্শনে যেতে পারেন।
ভবন পরিদর্শনে গিয়ে কোনো ব্যত্যয় পেলে শুধু ভবনমালিকই নন, রাজউকের যে ইমারত পরিদর্শক পরিদর্শনের দায়িত্বে ছিলেন, তাঁকেও শাস্তির আওতায় আনতে হবে বলে মত দেন আকতার মাহমুদ।রাজউক সূত্রে জানা গেছে, পরিদর্শনে নকশার বিচ্যুতি পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট ভবনমালিককে রাজউকের পক্ষ থেকে নোটিশ দেওয়া হয়। এতে সমাধান না হলে উচ্ছেদ অভিযানে যায় রাজউক। তবে রাজউকের সংশ্লিষ্ট মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

বিচ্যুতির তুলনায় উচ্ছেদ কম
রাজউকের ২০২০-২১ অর্থবছরের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মোট ১৫ হাজার ৯৯৩টি ভবন পরিদর্শন করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০৪টি ভবনে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। অর্থাৎ বিচ্যুতির তুলনায় উচ্ছেদের সংখ্যা কম।বিচ্যুতির তুলনায় উচ্ছেদের সংখ্যা কম কেন, জানতে চাইলে রাজউকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মামলা করা হয় এবং একপর্যায়ে রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের শিথিলতার কারণে বিচ্যুতি ঘটিয়ে নির্মিত ভবনের বিরুদ্ধে আর দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।রাজউকের এই কর্মকর্তার মতে, নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মিত সব ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন। কারণ, রাজউক অনুমোদিত ভবনের চেয়ে কোনো ধরনের অনুমোদন নেই, এমন ভবনের সংখ্যাই বেশি।

অনুমোদনহীন ভবনের সংখ্যা কত
ঢাকায় মোট কত ভবন আছে, অনুমোদনহীন ভবনের সংখ্যা কত, তার কোনো সঠিক তথ্য রাজউকে পাওয়া যায়নি।তবে রাজউকের প্রক্রিয়াধীন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) ভৌত জরিপ অনুযায়ী, সংস্থার আওতাধীন ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকায় (ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, সভার উপজেলা, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের আংশিক) প্রায় ২১ লাখ ৪৫ হাজার স্থাপনা আছে।জরিপে দেখা যায়, রাজউকের এলাকায় ২০০৬ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৯৫ হাজার নতুন স্থাপনা গড়ে উঠেছে। কিন্তু এ সময়ে রাজউক থেকে প্রতিবছর গড়ে ৪ হাজার ১৭৫টি স্থাপনার অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। সে হিসাবে এই ১০ বছরে নির্মিত স্থাপনার ৯৫ দশমিক ৩৬ শতাংশই অবৈধ।ড্যাপ ছাড়াও ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত একটি পৃথক জরিপ করে রাজউক। দোতলার বেশি ২ লাখ ৪ হাজার ১০৬টি ভবনের ওপর জরিপটি করা হয়। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, মিরপুর, মোহাম্মদপুর ও পল্লবী এলাকার ৯৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ ভবন; রামপুরা, মতিঝিল ও খিলগাঁও এলাকার প্রায় ৯৭ শতাংশ ভবন এবং ধানমন্ডি এলাকার প্রায় ৮৯ শতাংশ ভবন নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে।রাজউক সূত্রে জানা গেছে, ভবন নির্মাণের সংখ্যা ও রাজউক থেকে অনুমোদন নেওয়ার হার এখনো আগের মতোই আছে।সংস্থাটির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ হাজার ৯৩২টি ভবনের নির্মাণ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।রাজউক এলাকার বেশির ভাগ বহুতল ভবন (১০ তলার ওপর) হয়েছে এক থেকে দুই দশকের মধ্যে। এ ধরনের ভবনেও নকশার ব্যত্যয় আছে।২০১৮ সালের মার্চে রাজধানীর বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের পর রাজউক আওতাধীন এলাকার বহুতল ভবনের ওপর পরিচালিত জরিপে এ তথ্যের প্রমাণ পাওয়া গেছে।খোদ রাজউকের জরিপ বলছে, সংস্থাটির আওতাধীন এলাকায় ১ হাজার ৮১৮টি বহুতল ভবন আছে, যার ৮৪ শতাংশই নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে।এমন বাস্তবতায় রাজউক চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আগেও মনিটরিং কমিটি গঠন করেছিল রাজউক। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, সরেজমিনে রাজউক চেয়ারম্যান, সদস্য ও পরিচালকদের নির্মাণাধীন ভবন পরিদর্শনের সিদ্ধান্তকে চমকপ্রদ কথা ছাড়া অন্য কিছু মনে হচ্ছে না। যেসব ভবন নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলোর তথ্য রাজউকে আছে। তাহলে রাজউক কেন সেসব ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না?

অবৈধ ভবনের কী হবে

ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নকশার সামান্য ব্যত্যয় ঘটলে তা ভেঙে ঠিক করার সুযোগ আছে। কিন্তু কোনো ভবন যদি একেবারেই অবৈধ হয়, কোনো ধরনের নিয়মকানুন না মেনে তা নির্মাণ করা হয়, সে ক্ষেত্রে কী হবে?এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউকের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, অনুমোদন বা নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মাণ করা ভবনের হার এত বেশি যে সংস্থার পক্ষে সব ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন। এমন অবস্থায় বিকল্প হিসেবে প্রক্রিয়াধীন ড্যাপের খসড়ায় উচ্চহারে জরিমানার সুপারিশ করে ভবনের অবৈধ অংশ বা পুরো ভবন বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

রাজউকের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা

রাজউকের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা
 ছবি: সংগৃহীত

সুপারিশ অনুযায়ী, নির্মাণ ব্যত্যয়ের মাত্রার ওপর নির্ভর করবে জরিমানা। ব্যত্যয় করা অংশ ওই ভবন, পাশের ভবন ও পরিবেশের জন্য ঝুঁকির কারণ না হলে শুধু জরিমানা দিয়েই অনুমোদনহীন ভবন বা ভবনের অংশবিশেষের বৈধতা পাওয়া যাবে। আর কোনো ধরনের ঝুঁকি থাকলে সে ক্ষেত্রে ভবনের কাঠামোগত পরিবর্তন করতে হবে।সুপারিশে নিয়ম বা বিধি ভেঙে নির্মাণ করা ভবনগুলোকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। শ্রেণিগুলো হলো নির্মাণ অনুমোদন না নেওয়ার পরও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসরণ করা হয়েছে; অনুমোদন নেওয়া হয়েছে, কিন্তু নকশার ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে এবং অনুমোদন নেওয়া হয়নি, নির্মাণের বিধিও অনুসরণ করা হয়নি। এই তিন শ্রেণির ভবন জরিমানা দিয়ে বৈধতা পাবে।তবে মহাপরিকল্পনার ব্যত্যয় ঘটিয়ে, সরকারি জমি বা নাগরিক সুবিধার জন্য নির্ধারিত স্থান দখল করে, জলাশয় ভরাট করে, বেসামরিক বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত উচ্চতার সীমা লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণ করলে জরিমানা দিয়েও বৈধতা পাওয়া যাবে না।সুপারিশে ইমারত নির্মাণ ও বিধিমালা সংস্কার, ক্ষতিপূরণ দিয়ে ভবনের বৈধতা নেওয়ার ক্ষেত্রে পৃথক বিধিমালা প্রণয়ন ও মূল্যায়ন কমিটি গঠন, বিচ্যুতি অনুযায়ী ফি নির্ধারণ, তদারকি কমিটি গঠনসহ বেশ কিছু প্রস্তাব রাখা হয়েছে।জানতে চাইলে প্রক্রিয়াধীন ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক ও রাজউকের নগর-পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জরিমানার পরিমাণ কত হবে, কীভাবে জরিমানা আদায় করা হবে, কোন ক্ষেত্রে জরিমানা দিয়েও বৈধতা পাওয়া যাবে না—এসবসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে একটি নীতিমালা করা হবে। এই নীতিমালা অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *