অস্তগামী সূর্যই এনেছিল সকাল

সারা পৃথিবীতে প্রবীণরা কমবেশি নির্যাতনের শিকার হন। ভয়াবহ কোভিড-১৯ আক্রমণ করলে বিপুলসংখ্যক প্রবীণ মানুষের মৃত্যু হয় যথাযথ চিকিৎসাসেবা ও যত্নের অভাবে। প্রবীণ নিবাসে একই সেবাকর্মী একাধিক প্রবীণের সেবাযত্ন করে দ্রুত রোগ ছড়িয়ে মৃত্যু ত্বরান্বিত করেছে। মৃত্যুর পরও সম্মানজনকভাবে বিদায় জানানো যায়নি। বিদায় দিতে হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুসারে। ১৫ জুন বিশ্ব প্রবীণ নির্যাতন সচেতনতা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। গণমাধ্যমে দিবসটির তাত্পর্য তুলে ধরা হয়। বিভিন্ন সংগঠন সভা, সমাবেশ, সেমিনার, শোভাযাত্রা, মানববন্ধনসহ নানা রকমের কর্মসূচি পালন করে। নির্যাতন মানে সবল শক্তিমান কর্তৃক দুর্বল অক্ষম ব্যক্তিকে দুঃখকষ্ট দেওয়া। এসব দুঃখকষ্ট অর্জিত কিংবা আরোপিত হতে পারে। প্রবীণরা সাধারণত শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, সামাজিক, আবেগিক ও যৌননির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। শারীরিক নির্যাতন হলো কিলঘুষি, চড়থাপ্পড়, ধাক্কালাথি, চুল টানা, গলা টিপে ধরা, ধারালো কিংবা ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে জখম করা, সময়মতো খাওয়ার খেতে না দেওয়া, চিকিৎসা ও ওষুধপত্রের ব্যবস্থা না করা। মানসিক নির্যাতন হলো কথা বন্ধ করে দেওয়া, গালাগালি করা, অক্ষমতা নিয়ে কটাক্ষ করা, কুৎসা রটানো, আলো বাতাসহীন ঘরে রাখা, বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া, বাথরুমে আটকে রাখা, পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন না করা, পছন্দের কাজ করতে বাধা দেওয়া। আর্থিক নির্যাতন হলো টাকাপয়সা, জমিজমা, বাড়িগাড়ি, সহায়সম্পদ কৌশলে কিংবা চাপ সৃষ্টি করে বেহাত করা, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, সঞ্চয়পত্র, ডেবিট-ক্রেডিট কার্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়া, সম্পদ বিক্রি করতে বাধ্য করা। আবেগিক নির্যাতন হলো বিশ্বাস, ভালোবাসা, ভালো লাগার বিষয়কে গুরুত্ব না দেওয়া কিংবা উপহাস করা। পছন্দের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করার ক্ষেত্রে শর্ত আরোপ করা কিংবা বাঁধা দেওয়া। বেড়াতে যেতে, আড্ডা দিতে, সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করতে, সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে নিরুৎসাহিত করা। সামাজিক নির্যাতন হলো সামাজিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অন্তর্ভুক্ত না করা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় না রাখা, কুত্সা রটানো, বুলিং করা, অপবাদ দেওয়া, সামাজিক অনুষ্ঠানের নামে চাঁদাবাজি করা। যৌননির্যাতন হলো, সম্মতি ব্যতিরেকে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন, অশ্লীল কথা কিংবা ছবি দেখানো, গায়ে হাত দেওয়া, আদি রসাত্মক গল্প-কবিতা-ছড়া বলা, হাসিঠাট্টা-তামাশা করে যৌন ইঙ্গিত করা। গোসল অথবা ব্যক্তিগত পরিষ্কারপরিচ্ছন্নতার সময় অপ্রয়োজনে গা উদোম করে রাখা নির্যাতনের বেশির ভাগ ঘটনা জনসম্মুখে আসে না। মানসম্মানের ভয়ে নির্যাতনের খবর গোপন রাখা হয়। মাঝেমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব নির্যাতনের সংবাদ প্রকাশ হয়ে পড়ে। প্রবীণদের ওপর নির্যাতন যেন আমাদের গা সয়ে গেছে। অনেকেই এ কথা মুখে অস্বীকার করলেও অন্তরে লালন করে। মুখে মুখে আমরা কেউ কেউ বাবামায়ের জন্য আকুল রোদন করে সামাজিক সহানুভূতি লাভের চেষ্টা করি। মা দিবস, বাবা দিবস, পরিবার দিবস পালনের মধ্য দিয়ে প্রবীণ পিতামাতার প্রতি যে শ্রদ্ধা ভালোবাসা নিবেদন করি, অবশ্যই তা আমাদের জন্য অনুপ্রেরণামূলক। প্রবীণদের প্রতি নির্যাতন অবহেলা অসম্মান প্রদর্শন দিবস পালনকে ম্লান করে দেয়। প্রবীণরা মূলত পরিবারের সদস্যদের হাতে বেশি নির্যাতিত হয়ে থাকে। সিনিয়রদের সম্মান প্রদানের ক্ষেত্রে আমাদের কৃপণতা দৃশ্যমান। আমরা সম্মান করি ক্ষমতাবানদের। তাদের ছায়ায়, মায়ায়, দয়ায় থাকা আমাদের অভ্যাস। প্রবীণরা সেবাযত্ন আশা করেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে চান। সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে চান। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের সাহচর্য আশা করেন। সরকারি-বেসরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে সম্মান, মর্যাদা, মনোযোগ চান। খাওয়া-দাওয়ার, চলাচল, যানবাহনে , অফিসআদালতে, পরিবারে, রাস্তাপারাপারে অপেক্ষাকৃত তরুণদের মনোযোগ সহযোগিতা কামনা করেন। প্রবীণদের এই চাহিদা পূরণ করা আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আজকের বর্তমান তৈরিতে এই প্রবীণদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। আমাদের প্রবীণদের সন্তাননির্ভর, প্রবীণজীবনের ভাবনাকে সমাজনির্ভর প্রবীণ জীবনের ভাবনায় উন্নীত করতে হবে। প্রবীণদের প্রতি সম্মান ও মনোযোগ প্রদর্শন করে একটি প্রবীণবান্ধব সমাজ গড়ে তুলতে হবে। কারণ আগামী দিনের প্রবীণরা সেখানে বসবাস করবেন। মানুষের মনোভাব এখন এমন যে, অস্তগামী সূর্যের বিদায় যেমন নতুন সকালের স্বপ্ন দেখায়, তেমনি আমাদের প্রবীণদের বিদায় ঝামেলামুক্ত দিনের আশা জাগায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, যে সূর্য অস্তগামী, এই সূর্যই সকাল এনেছিল। মনে রাখতে হবে, প্রবীণরা কারো দয়া কিংবা করুণার পাত্র নন। তাদের দক্ষতাযোগ্যতা- অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে একটা প্রবীণবান্ধব সমাজ গড়ে তোলার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার এখনই সময়।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রবন্ধকার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *