সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন মানুষ

কেউ সঞ্চয়পত্র ভেঙে খাচ্ছেন, কেউ সংসার চালাচ্ছেন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা শেয়ার লোকসানে বিক্রি করে। সব মিলিয়ে চাপে আছেন সাধারণ মানুষ।

সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ১০০% কমেছে

ঢাকার নিউ ইস্কাটনের বাসিন্দা শিউলি তাবাসসুম একটি বেসরকারি স্কুলে চাকরি করতেন। করোনার কারণে স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেছে। ছেলেমেয়ে স্কুলে পড়ে। একমাত্র উপার্জনকারী স্বামীর আয়েও সংসার আর চলছে না। মেয়াদ পূর্তির আগে তো বটেই, এক বছর না যেতেই গত জুন মাসে পাঁচ লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে দেন তাবাসসুম শিউলি।তাবাসসুম শিউলি বলছিলেন, ‘ছেলেমেয়ে নিয়ে যখন স্কুলে যাই, পরে অনেক মায়ের সঙ্গেই আড্ডা হয়। এখনকার আড্ডার বিষয়বস্তু হচ্ছে কে কত টাকার সঞ্চয়পত্র ভেঙে কত টাকার লোকসান গুনেছেন। অনেকেই সঞ্চয়পত্র ভেঙে জমানো টাকা খরচ করছেন।’জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর থেকে গতকাল সোমবার পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, এক বছরের ব্যবধানে সঞ্চয়পত্র বিক্রি অর্ধেকেরও বেশি কমে গেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল ৪১ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকার। ২০২১-২২ অর্থবছরে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয় ১৯ হাজার ৯১৬ কোটি টাকা।ছয় মাসের চিত্র বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি হয় ২ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকার। জুন মাসে মূল জমা হয় ১০ হাজার ৭১২ কোটি টাকার, আর মুনাফা পরিশোধ হয় ৩ হাজার ৯৮০ কোটি টাকার। অর্থাৎ জুনে যাঁরা সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই আর নতুন করে বিনিয়োগ করেননি। সে হিসাবে জুনে নিট বিক্রি দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। ছয় মাস আগের সময়কে ভিত্তি ধরলে জুনে কম বিক্রি ৮৩৬ কোটি টাকা।তার এক মাস আগে অর্থাৎ মে মাসে মোট জমা হয়েছে ৭ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র। এ সময়ে মূল অর্থ ও মুনাফা পরিশোধ করা হয়েছে ৭ হাজার ২২৬ কোটি টাকা। সে হিসাবে ওই মাসে নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৩৮ কোটি টাকা।‘মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্বব্যাপী সংকট চলছে। আমাদের দেশে তেল ও খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি ডলারের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে। এর ফলে প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ বড় চাপে পড়ে গেছেন। অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। যাঁদের সঞ্চয় নেই, তাঁদের পরিস্থিতি আরও দুঃসহ। এতে জীবনযাত্রার মান কমে যাচ্ছে। অনেকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছেন।’মুস্তাফা কে মুজেরি, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক

ব্যাংক আমানতে লাভ কম

জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় ব্যাংক খাতে আমানতও সেভাবে বাড়ছে না। কারণ, ব্যাংকে আমানত রেখে যে সুদ মিলছে, তা দিয়ে মূল্যস্ফীতির ঘাটতি পূরণ হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত মে মাস শেষে ব্যাংক খাতে আমানত দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৩৬ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা, এপ্রিলে যা ছিল ১৪ লাখ ২৬ হাজার ৩৮৪ কোটি টাকা। আপাতদৃষ্টে আমানত বাড়ছে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে সেভাবে বাড়ছে না। কারণ, আমানতের সুদ যুক্ত হচ্ছে এতে।ব্যাংকগুলোর আমানতে যে টান পড়েছে, কয়েকটি ব্যাংকের চিত্র দেখলেই তা বোঝা যায়। যেমন ২০২১ সালের শেষে জনতা ব্যাংকের আমানত ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। গত ২৬ জুলাই তা কমে হয়েছে ৯৭ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা।একই সময়ে অগ্রণী ব্যাংকের আমানতও ছিল ১ লাখ কোটি টাকার বেশি। গত জুলাই শেষে তা ৯৪ হাজার কোটি টাকায় নেমে আসে। একই অবস্থা সোনালী ও রূপালী ব্যাংকেরও। বেসরকারি ব্যাংকের অবস্থাও প্রায়ই একই।কারণ হিসেবে সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, সুদ কম হওয়ায় নতুন আমানত মিলছে না। আবার প্রতিনিয়ত বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে হচ্ছে। এ জন্য আমানত কমছে।এদিকে ব্যাংকগুলোকে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে মেয়াদি আমানতের সুদহার নির্ধারণের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে মূল্যস্ফীতি বাড়ায় ব্যাংকগুলো আর আমানতের সুদহার বাড়াতে পারছে না। কারণ, ঋণের সুদহারের সীমা সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।এদিকে ব্যাংকমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস গভর্নরের কাছে দেওয়া এক চিঠিতে এসএমই ও ভোক্তা ঋণে সুদহারের সীমা তুলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে। তারা বলেছে, এসব ঋণে সুদ বাড়লে ঋণ কমবে। যার প্রভাবে মূল্যস্ফীতি কমতে পারে।বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুনে ঋণের গড় সুদহার ছিল ৪ শতাংশ। তবে ব্যক্তিপর্যায়ের মেয়াদি আমানতে ব্যাংকগুলোতে সুদহার এখন ৬ থেকে ৭ শতাংশে মধ্যে। আর দুর্বল ব্যাংকগুলোতে সুদহার আরও বেশি।বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক মুস্তাফা কে মুজেরি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্বব্যাপী সংকট চলছে। আমাদের দেশে তেল ও খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি ডলারের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে। এর ফলে প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ বড় চাপে পড়ে গেছেন। অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। যাঁদের সঞ্চয় নেই, তাঁদের পরিস্থিতি আরও দুঃসহ। এতে জীবনযাত্রার মান কমে যাচ্ছে। অনেকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছেন।’মুস্তাফা কে মুজেরি আরও বলেন, এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার বাড়াতে পারে। এ জন্য ঋণের সুদহারের সীমাও তুলে দেওয়া যায়। সুদহার বেঁধে দিয়ে কোনো দেশের অর্থনীতি বেশি দূর এগোতে পারে না বলেও মনে করেন তিনি।প্রথমে কোভিড-১৯ ও পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ—এ দুটি হচ্ছে মোটাদাগে মানুষের কষ্টের কারণ। আমরা কাল (আজ মঙ্গলবার) থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে টিসিবির মাধ্যমে কিছু পণ্য বিক্রির কার্যক্রম আবার উদ্বোধন করছি। নির্দিষ্ট আয়ের মানুষেরা একটু স্বস্তি পাবেন, যদি যুদ্ধটা থেমে যায় এবং বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য কিছুটা কমে যায়। আমরা সেই অপেক্ষায় আছি।’

শেয়ারবাজারের পতনপ্রবণতা

গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর থেকে শেয়ারবাজারে দরপতন দেখা দেয়। ওই যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজার ও দেশের বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি এবং ডলার-সংকট দেখা দিলে তাতে বাজারে পতন আরও ঘনীভূত হয়। তাতে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স সাড়ে পাঁচ মাসের ব্যবধানে ৬৭৫ পয়েন্ট বা ১০ শতাংশ কমে গেছে। একপর্যায়ে সূচকটি কমে ৬ হাজার পয়েন্টের মনস্তাত্ত্বিক সীমার নিচে নেমে আসে। পতন ঠেকাতে গত রোববার থেকে শেয়ারের সর্বনিম্ন দাম বা ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেওয়া হয়।বাজার-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারের মন্দাভাবের কারণে অনেকে বড় ধরনের পুঁজি হারিয়েছেন। বিশেষ করে যাঁরা ঋণ করে বাজারে বিনিয়োগ করেছিলেন, তাঁরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কারণ গত ছয় মাসের ব্যবধানে কোনো কোনো শেয়ারের দাম ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। এতে ঋণগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের বড় একটি অংশের শেয়ার জোর করে বিক্রি বা ফোর্সড সেলের আওতায় পড়েছে।সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ছয় মাসে হাতে গোনা কিছু শেয়ার ছাড়া ভালো ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করেও কোনো মুনাফা পাননি বিনিয়োগকারীরা। অথচ বাজারে বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ শেয়ার ব্যবসা করে পরিবার চালান। তাঁদের বড় অংশই মুনাফা তো দূরে থাক, পুঁজি হারিয়ে চাপে পড়েছেন। অথচ এ সময় বাজারে হু হু করে বেড়েছে সব ধরনের পণ্যের দাম। তাতে জীবনযাত্রার খরচ অনেক বেড়ে গেছে। সেই খরচ সামাল দিতে বাড়তি আয়ের আশায় যাঁরা শেয়ারবাজারমুখী হয়েছেন, তাঁরা আরও বেশি বিপদে পড়েছেন।চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) শেয়ার ব্যবসা করা একজন বিনিয়োগকারীর সঙ্গে গতকাল মুঠোফোনে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘গত নভেম্বরের পর থেকে ধ্বংস হয়ে গেছি।’ কারণ কী—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাজারকে বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু জানতাম না যে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এ বাজারের প্রতি দরদের ঘাটতি আছে।’

জিনিসপত্রের দামের ধাক্কা

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যই বলছে, নিত্যপণ্যের বাজারে প্রায় প্রতিটি নিত্যপণ্যেরই বাড়তি দাম। চালের কথা যদি ধরা হয়, মধ্যবিত্ত মানুষেরা সাধারণত সরু ও মাঝারি চালের ভোক্তা। এ বছরের ২ জানুয়ারি সরু চালের কেজি ছিল ৫৯ থেকে ৬৮ টাকা কেজি। গতকাল ১ আগস্ট তা প্রতি কেজিতে ৩ থেকে ৭ টাকা পর্যন্ত বেড়ে হয় ৬২ থেকে ৭৫ টাকা। মাঝারি মানের চালও বেড়েছে কেজিতে দুই টাকা।জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি ও মানুষের কষ্টের কথা স্বীকার করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমে কোভিড-১৯ ও পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ—এ দুটি হচ্ছে মোটাদাগে মানুষের কষ্টের কারণ। আমরা কাল (আজ মঙ্গলবার) থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে টিসিবির মাধ্যমে কিছু পণ্য বিক্রির কার্যক্রম আবার উদ্বোধন করছি। নির্দিষ্ট আয়ের মানুষেরা একটু স্বস্তি পাবেন, যদি যুদ্ধটা থেমে যায় এবং বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য কিছুটা কমে যায়। আমরা সেই অপেক্ষায় আছি।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *