‘লাইভ আত্মহত্যা’ ঠেকাতে বার্তা দিচ্ছে ফেসবুক ও টিকটক

ডেস্ক খবরঃ

নাটোরের এক ব্যবসায়ী ফেসবুক লাইভে এসে গত শনিবার নানা হতাশার কথা বলতে থাকেন। এরপর তিনি আত্মহননের প্রস্তুতি নেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ওই ব্যবসায়ীর ব্যাপারে তাৎক্ষণিক তথ্য বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির কাছে পৌঁছে দেয় ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। এরপর দ্রুত ব্যবসায়ীর বাসায় পৌঁছে যায় পুলিশের একটি দল। আত্মহত্যার চেষ্টা ঠেকানো হয়। এরপর তাকে কাউন্সেলিং করানো হয়েছে। এখন মানসিকভাবে আগের চেয়ে অনেক ভালো আছেন ওই ব্যবসায়ী। গত তিন মাসে ফেসবুক ও টিকটকের কাছ থেকে তাৎক্ষণিক বার্তা পেয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় এভাবেই ৩১ জনের আত্মহত্যা ঠেকানো গেছে।

কোন প্রেক্ষাপটে সিআইডিকে লাইভ আত্মহত্যার প্রস্তুতির আগাম তথ্য জানাচ্ছে ফেসবুক ও টিকটক? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি নায়ক রিয়াজের শ্বশুর ফেসবুক লাইভে এসে নানা হতাশার কথা দীর্ঘসময় ধরে জানানোর পর আত্মহননের ঘটনাটি দেশ-বিদেশের অনেককে নাড়া দেয়। এর পরই ফেসবুক ও টিকটকের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগাযোগ করে সিআইডি।

লাইভে আত্মহত্যার আলামত ও ইঙ্গিত পেলে কীভাবে সেই তথ্য বাংলাদেশ পেতে পারে সেই পরামর্শ চাওয়া হয়। এরপর ফেসবুকের আঞ্চলিক কার্যালয় সিঙ্গাপুর ও টিকটকের ভারতের অফিস থেকে ইতিবাচক সাড়া দেওয়া হয়। সিআইডির একটি টিম রয়েছে তারা আত্মহত্যার তথ্য আগাম পাওয়ার ব্যাপারে তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করে থাকে। এই উদ্যোগের ইতিবাচক ফল পাচ্ছে বাংলাদেশ।

এ ব্যাপারে সিআইডির সাইবার ক্রাইম ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত ডিআইজি কামরুল আহসান সমকালকে বলেন, ফেসবুক ও টিকটকের স্বতন্ত্র কিছু কারিগরি দিক রয়েছে। তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে পারেন, কোনো ব্যক্তি লাইভে আত্মহত্যার দিকে যাচ্ছেন কিনা এটা নিশ্চিত হওয়ার পরই ওই ব্যক্তি সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য ই-মেইলের মাধ্যমে সিআইডিকে জানানো হয়।

কামরুল আহসান আরও বলেন, আত্মহত্যা করতে যাচ্ছেন এমন কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে তথ্যটি পাওয়ার পরই দ্রুত তার বাসার নিকটস্থ সিআইডির সদস্যদের জানানো হয়। তারা ওই ব্যক্তিকে উদ্ধার করেন। যেখানে সিআইডির সদস্যরা কাছাকাছি নেই সেখানে পুলিশের অন্য ইউনিটের সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে।

সিআইডির অপর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, এখন পর্যন্ত যে ৩১ জনের ব্যাপারে তথ্য পাওয়া গেছে তাদের বেশিরভাগ নারী। অধিকাংশরা অভিমান করে আত্মহত্যার কথা ভাবছিলেন। ওই পথ থেকে ফেরত এনে বেশ কয়েকজনকে পুলিশ সদস্যরা কাউন্সেলিং করেছেন। আবার কাউকে চিকিৎসকের কাছে পাঠানো হয়। এখন অনেকের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে পুলিশ। সিআইডি যাদের উদ্ধার করেছে তারা বয়সে তরুণ। সর্বশেষ নাটোরে যে ব্যক্তি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তার স্ত্রী দীর্ঘদিন ভারতে অবস্থান করছেন। স্ত্রী দেশে ফেরত না আসার মনোকষ্টে নিজের জীবন কেড়ে নেওয়ার কথা ভাবছিলেন তিনি।

সিআইডির আরেক কর্মকর্তা জানান, রিয়াজের শ্বশুরের ঘটনার আগেও ফেসবুক ও টিকটকের সঙ্গে সিআইডির তথ্য আদান-প্রদানে এক ধরনের যোগাযোগ ছিল। তবে ওই ঘটনার পর সুনির্দিষ্ট লাইভ আত্মহত্যা ঠেকানোর আগাম তথ্য চাওয়া হয়। এখন সমন্বিত প্ল্যাটফর্মের মধ্য দিয়ে এই ঘটনার তথ্য পাচ্ছে বাংলাদেশ।

তরুণদের সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে উঠে আসে এক বছরে সারাদেশে আত্মহত্যা করেছে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন নারী-পুরুষ। পারিবারিক জটিলতা, সম্পর্কের অবনতি, পড়াশোনা নিয়ে হতাশা, আর্থিক সংকট, মান-অভিমান আত্মহননের মূল কারণ। ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ৩টি জাতীয় পত্রিকা, ১৯টি স্থানীয় পত্রিকা, হাসপাতাল ও থানা থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করে আঁচল ফাউন্ডেশন। তারা দাবি করছে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে আত্মহত্যা ৪৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, ২০১৯ সালে সারাদেশে আত্মহত্যা করেছে ১০ হাজারের বেশি মানুষ।

আত্মহত্যার ঘটনার তথ্য বিশ্নেষণে দেখা যায়, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ২০-৩৫ বছর বয়সী রয়েছেন ৪৯ শতাংশ, ৫-১৯ বছর বয়সী ৩৫ শতাংশ, ৩৬-৪৫ বছর বয়সী ১১ শতাংশ, ৪৬-৮০ বছর বয়স ৫ শতাংশ। বিভিন্ন ধরনের পারিবারিক সমস্যার কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৩৫ শতাংশ নারী-পুরুষ। এর বাইরে ২৪ শতাংশ সম্পর্কের টানাপোড়েনের কারণে এবং অজানা কারণে ৩২ শতাংশ মানুষ এই পথ বেছে নেয়। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, অনেক মানুষ আবেগ ধরে রাখতে পারে না। তখন সামান্য কারণে আত্মহত্যার কথা ভাবে।

এ ব্যাপারে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহিত কামাল বলেন, আত্মহত্যার কয়েকটি ধরন রয়েছে। পরিকল্পিত, তাৎক্ষণিক ও দলবদ্ধ আত্মহনন। কারও মন গুরুতর বিষাদে নিমজ্জিত থাকলে পরিকল্পিতভাবে আত্মহত্যার কথা ভাবেন। আবার হতাশা থেকে কারও বাইরের মন চায় পৃথিবী ছেড়ে যেতে আর ভেতরের মন বাঁচতে চায়। অনেকে আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় জীবনের হতাশার কথা তুলে ধরে পোস্ট দেন। এ ধরনের অবস্থায় সঠিক সময়ে পাশে এসে দাঁড়িয়ে কাউন্সেলিং করানো গেলে তাদের মনের সুপ্ত চিন্তার পথরেখা বদলে যায়। পুলিশ মানুষের মনের বিশেষ পরিস্থিতির কথা ভেবে যেভাবে এগিয়ে এলো- এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাতে হবে। তবে যারা বেঁচে গেল তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব এখানেই শেষ নয়। তাদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা সারিয়ে তোলার ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলো আবারও কোনো এক সময় তারা আত্মহত্যার কথা ভাবতে পারেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *