পদ্মা সেতু: এক দিনের জন্য টোল ফ্রির প্রস্তাব

স্বপ্ন শুধু মানুষ দেখে না, স্বপ্ন দেশও দেখে। যখন দেশের অধিকাংশ মানুষ কোনো কিছু চায় এবং সেই চাওয়াকে গুরুত্ব দেয় সরকার এবং সেই স্বপ্নটি সরকারও দেখতে শুরু করে—তখন সেই স্বপ্ন হয়ে যায় একটি দেশের। পদ্মা সেতুর স্বপ্ন ছিল পুরো বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের। সেই স্বপ্নের সেতুর উদ্বোধন ২৫ জুন। এর আগে আরেক স্বপ্নের সেতু বঙ্গবন্ধু সেতুর (যমুনা ব্রিজ) উদ্বোধন হয়েছিল। তারও আগে উদ্বোধন হয়েছিল দক্ষিণ বাংলার স্বপ্নের গাবখান সেতুর। বুড়িগঙ্গা সেতুও উদ্বোধন হয়েছিল। উদ্বোধন হয়েছিল কুড়িল ফ্লাই ওভার, মৌচাক ফ্লাইওভারসহ আরো অনেক স্হাপনার। তবে এতটা আলোচনার জন্ম দেয়নি কোনোটিই, যতটা আলোচিত হচ্ছে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন নিয়ে। কারণ পদ্মা সেতুর কাজ যখন প্রায় গোছানোর পথে তখনই শুরু হয় কথিত ‘দুর্নীতি’র অভিযোগ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ জন্মের পর থেকে এ পর্যন্ত অনিয়মের অভিযোগ মাথায় নিয়ে কোনো মন্ত্রী পদত্যাগ করেননি। ব্যতিক্রম এক জনই তিনি সৈয়দ আবুল হোসেন। অভিযোগ উঠেছিল সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীর বিরুদ্ধেও। পদ্মা সেতু প্রকল্পের কানাডার একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের জন্য ঘুষ নেওয়ার ব্যাপারে ষড়যন্ত্র হয়েছিল— এমন অভিযোগ এনে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থ-সহায়তা থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল বিশ্বব্যাংক। আর এসবের কারণে মন্ত্রিত্ব থেকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ান সৈয়দ আবুল হোসেন। বিষয়টি গড়ায় বাংলাদেশের দুদক এবং কানাডার আদালত পর্যন্ত। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতি বা ষড়যন্ত্রের সব অভিযোগ থেকে সন্দেহভাজন সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীসহ অভিযুক্ত সবাইকে অব্যাহতি দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন—দুদক। দুদক বলেছে, ‘বিশ্বব্যাংক তথ্য-প্রমাণ দিয়ে সহযোগিতা করতে চেয়েছিল। কিন্তু পরে আদালতে প্রমাণের মতো কোনো তথ্য তারা দিতে পারেনি। কানাডার পুলিশ যে তদন্ত করেছিল, তাতে তারা তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়। কোনো দালিলিক প্রমাণ বা সাক্ষ্য না পাওয়ায় চূড়ান্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে মামলার নিষ্পত্তি করা হয়েছে। অহেতুক অভিযোগ আনা হয়েছিল।’ কানাডিয় কোম্পানি এসএনসি-লাভালিনকে কাজ পাইয়ে দিতে দুর্নীতির চেষ্টা করা হচ্ছে বলে রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশকে অভিযোগ করেছিল বিশ্বব্যাংকের ইন্টিগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্সি (আইএনটি) বিভাগ। ফলে মামলা হয় কানাডার আদালতে। কিন্তু উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ দিতে না পারায় পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের কোনো প্রমাণ পায়নি সে দেশের আদালত। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে অভিযু্ক্ত সবাইকে নির্দোষ ঘোষণা করে রায় দেন আদালত। এমন ঐতিহাসিক রায়ের ফলে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির যে অভিযোগ এনেছিল বিশ্বব্যাংক তা থেকে দায়মুক্তি পায় বাংলাদেশ। কানাডার শীর্ষ ইংরেজি দৈনিক টরেন্টো স্টারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রায়ের আদেশে বিচারক লেখেন, ‘অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যে তথ্য উপস্হাপন করা হয়েছিল, তা গুজব ও জনশ্রুতি। উপস্হাপিত নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২ নম্বর তথ্যদাতা এক জন ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ। তিনি নিজেও পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজের দরপত্রে অংশ নিয়েছিলেন এবং কাজ পাওয়ার জন্য দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছিলেন। টরেন্টো স্টার তাদের প্রতিবেদনে আরো বলেছেন, সেতু প্রকল্পের কাজ পেতে কেভিন ওয়ালেসসহ তিন জন দুবাইয়ে বৈঠক করেছেন এবং তারা কানাডার পিয়ারসন বিমানবন্দর দিয়ে দেশে ফিরেছেন। কিন্তু কানাডা বর্ডার সার্ভিসেস এজেন্সি-সিবিএসএ বলেছে, কেভিন ওয়ালেস ঐ সময় দুবাই যাননি। এই ঘটনাগুলো বারবার প্রমাণ করেছেন পদ্মা সেতু নিয়ে আসলে দুর্নীতি হয়নি, হয়েছে ষড়যন্ত্র। এটা দিয়ে আরো প্রমাণিত হয়েছে, বিশ্বের উন্নত দেশের নাগরিকরাও দুর্নীতি করে, ষড়যন্ত্র করে। তারাও কাজ পাওয়ার জন্য, নিজে লাভবান হওয়ার জন্য অন্যের ক্ষতি করে। তারাও নয়ছয় করে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে। কানাডার আদালত যখন রায় দিয়েছেন তার আগেই ঘটেছে অনেক কিছু। পদ্মা সেতু নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে হরিলুটের, প্রশ্ন তোলা হয়েছে স্বচ্ছতার। সৈয়দ আবুল হোসেনসহ অভিযুক্তরা আদালতের মাধ্যমে এই যে নিষ্কলুস, নিষ্কলঙ্ক প্রমাণিত হলেন আমাদের উচিত তাদের নিয়ে গর্ব করা। ফুলের মালা পরানো। সম্মানিত করা। কারণ আবুল হোসেনরা যদি প্রশ্ন করেন কী দোষ আমাদের? তাহলে কী উত্তর দেবেন সরকার বা সমালোচনাকারীরা? তাই পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের দিন সৈয়দ আবুল হোসেনকে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধির পাশে বসিয়ে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া উচিত। তাদের বোঝানো উচিত, নয়ছয় তোমরাও করো। এই পদ্মা সেতু আজ বাস্তবতা। পদ্মা সেতু তৈরিতে বাংলাদেশের মানুষের রক্তঘাম, শ্রমের সম্মিলিত প্রচেষ্টা রয়েছে। পদ্মা সেতুর অর্থায়নে ভূমিকা আছে শ্রমিকের, ভূমিকা আছে শিক্ষকের, শিক্ষার্থীদের, মোবাইল ব্যবহারকারীদের, ড্রাইভারের, গৃহিণীসহ সব পেশার মানুষের। এরাই পদ্মা সেতুর মালিক। তাই যে দিন থেকে যানবাহন চলাচল উন্মুক্ত হবে সেদিন সবার জন্য টোল ফ্রি ঘোষণা করা হোক। এটা সরকারের পক্ষ থেকে জনগণের জন্য উপহার। দ্বিতীয় দিন থেকে স্বাভাবিক নিয়মে টোল নেওয়া হোক। একটা দিনের জন্য টোল নেওয়া না হলে এমন কি-ই-বা ক্ষতি হবে? প্রত্যেকটি জাতির কাছে তার আত্মসম্মান বা আত্মমর্যাদা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সুশাসন, গণতন্ত্র, দুর্নীতিসহ নানা বিষয় নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও পদ্মা সেতু ইসু্যতে বাংলাদেশ বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে আমাদেরও আত্মসম্মান আছে, আছে আত্মমর্যাদা। আমার মনে হয়, পদ্মা সেতু ইস্যুতে ঋণ প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশ যে আত্মসম্মান দেখিয়েছে তা চিরকাল স্মরণ রাখবে বিশ্বব্যাংক।

লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, চ্যানেল আই, সভাপতি, বাংলাদেশ অ্যাডুকেশন রিপোর্টার্স, ফোরাম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *