গত তিন বছরে বর্তমান অর্থমন্ত্রী যেমন গতানুগতিক বাজেট দিয়েছেন, এ বছরের বাজেটেও তার থেকে ব্যতিক্রম কিছু নেই; কিন্তু বাস্তবে কি এবার গতানুগতিক বাজেটের বছর ছিল? এবারের বাজেটের বক্তৃতা কি গত তিন বছরের মতোই বাজেট বক্তৃতা দেওয়ার বছর ছিল? এ বছরটা কি অনেক বেশি রাজনৈতিক দিকনির্দেশনাসহ ভবিষ্যতের জন্য একটা দীর্ঘ রূপরেখা দেওয়ার বছর ছিল না? এবার যখন পার্লামেন্টে বাজেট পেশ হয়েছে তখন পৃথিবীতে কোভিড পুরোপুরি শেষ না হলেও দুই বছরের কোভিড-উত্তর অর্থনীতির যাত্রা শুরু হয়েছে। অন্যদিকে তার সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধ অনেক দীর্ঘ মেয়াদে চলে যাচ্ছে, তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। কারণ, ইতিমধ্যে রুশ সেনারা ইউক্রেনের যে যে অংশ দখল করে নিয়েছে, সেখানে অন্তত দুই জায়াগাতে গাড়িবোমা হামলা করেছে ইউক্রেনের গেরিলারা। অন্যদিকে ন্যাটো ইউক্রেনকে মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিচ্ছে। তাই ইউক্রেন যে আরেকটি আফগানিস্তান বা ভিয়েতনাম হতে চলেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ইউক্রেন আফগানিস্তান বা ভিয়েতনামের থেকে আরো ভয়াবহ এই কারণে ঐ দুই দেশের যুদ্ধ গোটা বিশ্বকে আক্রান্ত করেনি; কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ ইতিমধ্যে অনেকখানি করেছে, আগামী অন্তত দুই বছরে এটা আরো বেশি পৃথিবীর অর্থনীতি ও রাজনীতিকে আক্রান্ত করবে। তাই এমন একটি সময়ে বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য যে বাজেটটি দরকার ছিল, সেটা যেমন ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য হবে তেমনি আগামী অন্তত পাঁচ বছরের একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনাও থাকার প্রয়োজন ছিল। যেমন এ মুহূর্তে গোটা পৃথিবী দ্রব্যমূল্যের চাপে ভুগবে। বাংলাদেশও তার থেকে বাদ যাবে না। আর এই দ্রব্যমূল্য বাড়ার প্রভাবটা সমাজে বেশ জটিল আকার নেবে। কারণ এখানে ক্ষত দুটো। এক, দুই বছরের পৃথিবী জোড়া কোভিড-১৯-এর ক্ষত। দুই, অর্ধেকের বেশি পৃথিবীর নানানভাবে জড়িয়ে পড়ার ফলে ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষত। তার ওপর পৃথিবীতে শুরু হয়েছে বড় আকারে অর্থনৈতিক অবরোধের যু্দ্ধ। একটা উদাহরণ দিয়েই যদি দেখা যায়, তাহলে দেখা যাচ্ছে— এই দুই কারণে যে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে ও ভবিষ্যতে বাড়বে তা দুই ধরনের লোকের ওপর দুইভাবে প্রভাব ফেলবে, এমনকি ফেলছেও। যাদের কাজ আছে, অর্থাত্ যারা কোভিডে কাজ হারাননি, তাদের নিজস্ব বাজেটের বাইরে চলে যাবে তাদের প্রয়োজন। ওদের প্রয়োজনকে ব্যাগে ঢোকাতে হলে আয় বাড়াতে হবে। এ মুহূর্তের বাস্তবতায় আয় বাড়বে কীভাবে? আর কোভিডে যারা কাজ হারিয়েছেন তারা সঞ্চয় বা সম্পদ বিক্রি করে চলছেন। ওদের প্রয়োজনকে ব্যাগে ঢোকাতে হলে তাদের এ দুই পথই দ্রুত শেষ হয়ে যাবে। তাই এই দ্রব্যমূল্য অন্তত নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রে কীভাবে কম রাখা যায় তার দীর্ঘমেয়াদি একটি রূপরেখা এ মুহূর্তে দরকার। কারণ যে সময়ে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায় সে সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সরকার মুদ্রামান নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যে নীতিই গ্রহণ করুক না কেন, তাতে দ্রব্যের মূল্য বেড়ে যাওয়াকে কমানো যায় না। কারণ, এই দ্রব্যমূল্য বাড়ার সঙ্গে উৎপাদন ও আমদানি জড়িত। এই বাজেটে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস দুটোই উৎপাদন ও পরিবহনের সঙ্গে জড়িত। এই উৎপাদন ব্যয় ও পরিবহন ব্যয়ই পণ্যের দাম বাড়া ও কমার অন্যতম নিয়ামক। এ দুটোর দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে প্রকৃত অর্থে কার্যকর দ্রব্যমূল্য কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে এই বাজেট তৈরি হয়নি। এ দুটোর দাম কমানো ছাড়া উৎপাদন ও পরিবহন ব্যয় কমবে না। দ্রব্যমূল্যও কমবে না। হয়তো এখানে কেউ বলতে পারেন, দ্রব্যমূল্য বাড়লে অনেক সময় লাভ বেশি হয়— তাতে ব্যবসা বাড়ে। কর্মসংস্থান হয়। সেটা ঘটে আয় বাড়ার ফলে, যে সময়ে দ্রব্যের চাহিদা বেড়ে গিয়ে দ্রব্যমূল্য বাড়ে তখন। আর বর্তমানে মানুষ যে দাম বাড়ার ফলে জিনিসপত্র কিনতে পারছে না—এই দুই দ্রব্যমূল্য বাড়ার চরিত্র এক নয়। তাই বর্তমানে যে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে এটার প্রকৃত কারণের ওপর দাঁড়িয়ে—মুদ্রাব্যবস্থা, বাজার, উৎপাদন ও বাণিজ্যনীতির দীর্ঘমেয়াদি রূপরেখারই প্রয়োজন ছিল। অন্য দিকে আমাদের দেশীয় উৎপাদিত পণ্য ও আমদানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ, একচেটিয়া ব্যবসা ও মজুতদারি। এই অবস্থা গড়ে উঠেছে দীর্ঘদিন ধরে। ২০০৮-এ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে মানুষের মনে একটা আশা জেগেছিল, প্রকৃত নির্বাচনের ভেতর দিয়ে আসা, প্রকৃত শক্তিশালী আওয়ামী লীগ এই একচেটিয়া ব্যবসা ভাঙবে; কিন্তু ২০০৮-এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিকভাবে যতটা শক্তিশালী সরকার হয়েছিল, ২০১৪-এর একপক্ষীয় নির্বাচন ও ২০১৮-এর অন্য ধরনের নির্বাচনের ফলে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক শক্তি কমে গেছে। বেড়েছে প্রশাসনিক ও অনৈতিক ব্যবসায়ীদের ক্ষমতা। যার ফলে এই একচেটিয়া ব্যবসা ও মজুতদারি আরো বেড়েছে। পাশাপাশি তারা শুধু পণ্যের ব্যবসা নয়, ব্যাংক প্রতিষ্ঠানেরও একটা বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। সম্প্রতি সয়াবিন তেল, পাম তেল ও চালের মজুত উদ্ধার তা প্রমাণ করেছে। এই একচেটিয়া ব্যবসা ভেঙে নতুন সিস্টেমে যাওয়ার রূপরেখা তাই স্বাভাবিকই এ বাজেটে থাকার দাবি রাখে; কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। অন্যদিকে যখনই কোনো যুদ্ধ বা মহামারির ক্ষতের ওপর কোনো অর্থনীতি দাঁড়ায়। যেখানে আমদানি পণ্য তার জন্য অনেক বড় বোঝা হয়ে যায়—সে সময়ে প্রত্যেকটি দেশ বিকল্প খোঁজে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ও যুদ্ধোত্তর জাপান, ইউরোপ ও আমেরিকা সেটা করেছে। তারা যেহেতু বেশি শিল্পনির্ভর দেশ, তাই নতুন উদ্ভাবনী শিল্পতে গিয়ে ক্ষত পোষানোর পথে যায়। আবার কৃষিনির্ভর দেশগুলো কৃষির দিকে নজর দেয়। যার ফলে অনেক কিছুই বদলে যায় পৃথিবীতে। বাংলাদেশ যেহেতু এখনো কৃষিনির্ভর— তাই কৃষির দিকে নজর দিতে হবে। যেমন আমাদের দুই ধরনের তেল। জ্বালানির জন্য ক্রড ওয়েল ও খাওয়ার তেল দুই-ই আমদানি করার প্রয়োজন পড়ে। বিশ্ববাজারে দুটোরই দাম বাড়ছে প্রতি দিন। এই বাজেটে তাই স্বাভাবিকভাবে থাকা উচিত ছিল আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যে, সরিষা, সয়াবিন ও সানফ্লাওয়ার উৎপাদন করে বাংলাদেশ কীভাবে ভোজ্য তেলের আমদানিনির্ভরতা কমাতে পারে। এবং বাজারে এ পণ্যের দাম কম রাখতে পারে। এভাবে কঠিন প্রয়োজনেই কিন্তু সব দেশে ফসল থেকে শুরু শিল্পেরও পরিবর্তন ঘটে। পাশাপাশি আমাদের আখের উৎপাদন অনেকটা হেলাফেলার কারণেই নষ্ট হচ্ছে। অথচ চিনি উৎপাদনের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি উৎপাদন করা সম্ভব। এভাবে প্রতিটি খাতকে চিন্তা করে একটি দীর্ঘমেয়াদি রূপরেখা এই বাজেট থাকা উচিত ছিল। কারণ, নিঃসন্দেহে এটা একটি পরিবর্তিত সময়ের বাজেট। এ সময়ে যদি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক রূপরেখা বা দিকনির্দেশনা না আসে তাহলে সেটা অনেক বড় ব্যর্থতা শুধু নয়, সমস্যাকে ভুলে থাকা। এই দীর্ঘমেয়াদি পথে হাঁটা ছাড়া যদি এই বাজেটকে কেবল একটি বছরের আয়ব্যয়ের হিসাব মনে করে—সমস্যা সামনে আসবে আর সেটা সমাধান করব, এমন একটা নীতিতে এগোনো হয়, তাহলে বাস্তবে কোনো সুফল মিলবে না। যেমন মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে মুদ্রানীতিতে কঠোরতা আনলে বিনিয়োগ কমে যাবে। তাতে কর্মসংস্থানের পথ আরো ছোট হয়ে আসবে। বিনিয়োগের জন্য ব্যবসায়ীদের যে প্রণোদনার প্রস্তাব ও সুবিধার কথা এ বাজেটে দেওয়া হয়েছে, এ কাজ তো গত দুই বছরেও করা হয়েছে। তাতে বিনিয়োগ কি বেড়েছে? কর্মসংস্থান হয়েছে? বরং সরকারের অনুদানে এক ধরনের প্রাইভেট খাত চলছে। শুধু তাই নয়, তাদের খেলাপি ঋণ ঢাকার জন্য আলাদা একটা পর্দা তৈরি করা হয়েছে। যে পর্দার আড়ালে পড়ে গেছে রাষ্ট্রের বিপুল অঙ্কের অর্থ নয়ছয় করার বিশাল চিত্র। আগামী নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকারের এটাই শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট। অন্যদিকে কোভিড-উত্তর ও যুদ্ধাক্রান্ত বিশ্বপরিস্থিতি। এ সময়ে নিঃসন্দেহে এসব পর্দা ছিঁড়ে ফেলে দেশকে এই ভয়াবহ বিশ্বপরিস্থিতির ভেতর দিয়ে স্বচ্ছভাবে এগিয়ে নেওয়ার জন্য দরকার ছিল একটি দীর্ঘমেয়াদি রূপরেখাসংবলিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিকনিদের্শনামূলক বাজেট। একটানা প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা একটা সরকারের কাছে এটাই ছিল প্রকৃত প্রত্যাশা।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক, সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত