একজন রিকশাওয়ালা, যৌন নিপীড়ক শিক্ষার্থী এবং একজন উপাচার্য

১৭ জুলাই রোববার দিবাগত রাতে জিইসির মোড়ে এ ঘটনা ঘটে। তার কয়েক ঘণ্টা আগে শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আরেকটি ঘটনা ঘটে। কয়েকজন তরুণ মিলে একজন ছাত্রীকে যৌন নিপীড়ন করেছেন। তাঁকে বেঁধে রেখে বিবস্ত্র করে ভিডিও করেছেন, ছিনিয়ে নিয়েছেন টাকা ও মুঠোফোনও।একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর তো তাঁর ক্যাম্পাসেই সবচেয়ে নিরাপদ থাকার কথা।বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রদের কাছেই সবচেয়ে বেশি নির্ভয়ে থাকার কথা একজন ছাত্রীর। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো অনুষ্ঠান—পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপন, বসন্তবরণ, নবীনবরণ, র‌্যালি, কনসার্ট, পিকনিকে সহপাঠী বা অগ্রজ-অনুজ সবার মধ্যে সেই নির্ভরতা কাজ করে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমরা দেখলাম, যৌন নিপীড়কেরা বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র। একজন অভিভাবক দূরদূরান্ত থেকে তাঁর মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান, শুধু এ কারণে যে—বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য ছেলেমেয়েও তো তাঁর সন্তানের মতো। এখন এমন ঘটনায় সেই বিশ্বাসে কি চিড় ধরার কথা না? বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠানো ছেলেও যে যৌন নিপীড়ক হয়ে উঠবেন, সেটিও–বা কীভাবে কল্পনায় আনতে পারেন কোনো অভিভাবক।পাহাড় ও সবুজে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসজীবন মানে তো হওয়ার কথা ছিল সজীবতা, উচ্ছলতা, সৌন্দর্যতা ও সুন্দরে পরিপূর্ণ। কিন্তু সেখানে যখন কোনো শিক্ষার্থী মোটরসাইকেল নিয়ে ক্যাম্পাস দাপিয়ে বেড়ান, তাতে শঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না। আমরা জানতে পারছি, যৌন নিপীড়ক সবাই ছাত্রলীগের কর্মী। এ ঘটনায় ঘুরেফিরে আসছে ক্যাম্পাস ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেলের নাম, শুরু থেকে যৌন নিপীড়কদের বাঁচাতে যিনি ছিলেন তৎপর। গত বছর সেপ্টেম্বরেও ক্যাম্পাসের ভেতরেই দুই ছাত্রীকে লাঞ্ছনার অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মীর বিরুদ্ধে, তাঁরাও ছিলেন রুবেলের অনুসারী।সভাপতি রুবেল ও সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপুসহ আরও ক্যাম্পাস ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা সম্পর্কে আমরা জানতে পারছি, যারা ১০ থেকে ১৬ বছর ধরে ক্যাম্পাসে পড়ে আছেন, নিজেদের ক্ষমতাচর্চা করে যাচ্ছেন। ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়া এসব নেতার উৎসাহেই অনুসারীরা ক্যাম্পাসে টেন্ডারবাজি, মাদকের প্রসার, ছিনতাই ও ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করাতেই নিজেদের ছাত্রজীবনকে নিয়োজিত করেছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেসবের বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না। যার ফলে একজন ছাত্রীকে বেধে রেখে বিবস্ত্র করে ভিডিও করার মতো গুরুতর ঘটনা ঘটে গেল।মজার কথা হচ্ছে, যে কুলষিত ছাত্ররাজনীতি এসব শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়ক বানাল, তাদের দায়িত্ব নিতে চায় না তারা। রুবেলের সঙ্গে যৌন নিপীড়ক ছাত্রের অনেক ফেসবুক পোস্ট ও একত্রে নানা সময়ের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। শুরুতে রুবেল তাঁদের বাঁচানোর চেষ্টা করলেও বিক্ষোভের পর বেগতিক দেখে অবস্থান পাল্টে ফেলেন। একনিষ্ঠ কর্মীকে এখন গালি দিয়ে নিজেকে ‘সাফসুতরো’ প্রমাণ করতেই ব্যস্ত তিনি। পেশিশক্তি ও ক্ষমতা প্রদর্শন করাই যে ছাত্রসংগঠনের লক্ষ্য হয়ে ওঠে, তার কর্মীদের জন্য জলজ্যান্ত এক কেস স্টাডি হতে পারে এ ঘটনা।

৩.

অবশেষে ঘটনার পাঁচ দিন পর যৌন নিপীড়কদের গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিরীণ আখতার সিনেটের এক সভায় বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ঘটনা ঘটেছে, এটি খুব লজ্জাজনক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত এ ঘটনার খোঁজখবর নিয়েছেন। তিনি বিশেষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পাঠিয়েছেন’ (২৩ জুলাই, প্রথম আলো)।আমাদের প্রশ্ন হলো, প্রধানমন্ত্রীকেই যদি এ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে হয়, তাহলে তিনি কী করছিলেন? শুরু থেকে এ ঘটনা জানাজানি হলেও প্রশাসন বরাবরের মতো কোনো ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করছিল। এরপর ভুক্তভোগী ছাত্রী যেদিন লিখিত অভিযোগ জানালেন, সেদিন উপাচার্য ছাত্রী হলে প্রবেশের সময়সীমা নির্ধারণ করে দিলেন; প্রভোস্ট, প্রক্টরসহ অন্যদের সঙ্গে এক বৈঠক করে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যার প্রতিবাদেই পরদিন রাতে ছাত্রীরা বিক্ষোভ শুরু করেন। সেখান থেকেই যৌন নিপীড়কদের বিরুদ্ধে অনড় অবস্থান তৈরি হয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে।বিশ্ববিদ্যালয়টির ইতিহাসে প্রথম নারী উপাচার্য থেকে আমরা এমন সিদ্ধান্ত পেয়ে অবাক হই। অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যৌন নিপীড়কদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে না গিয়ে পরোক্ষভাবে তিনি ভুক্তভোগীকেই দায়ী করলেন। বিষয়টি পোশাকের কারণে ধর্ষণের শিকার নারীকেই দায়ী করার মতো হলো না?আমরা আরও অবাক হই, বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পরদিনই ক্যাম্পাসে শিক্ষক সমিতির বর্ষাবরণ ও ফলাহারে যোগ দিলেন শিরীণ আখতার। একদিকে শহীদ মিনারে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করছেন, তার পাশেই ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদে একই সময়ে তিনি ফলাহার করছেন। কিছু শিক্ষক সে সময় সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু উপাচার্য হয়ে শিরীণ আখতার এ কেমন আচরণ করলেন! এ দেশের উপাচার্যরা আসলে এমন, সেই ‘সুনাম’ কি তিনি অক্ষুণ্ন রাখলেন? আমাদের অবাক হওয়ার পালা শেষ হয় না। কারণ, শিক্ষক সমিতি উদ্বেগ প্রকাশ করল তখন যৌন নিপীড়নের ঘটনার পাঁচ দিন পার হয়ে গিয়েছে, বর্ষাবরণ ও ফলাহার শেষে এ নিয়ে তাঁদের বোধোদয় হলো।বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা প্রকাশ্যে বলে বেড়াল, এত বড় ক্যাম্পাসে কী করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। তাছাড়া ওই ছাত্রী কেন নির্জন স্থানে ঘোরাফেরা করছিল। এসব কথার অর্থ দাঁড়ায়, নিরাপত্তা প্রশ্নে তাঁদের চিন্তায় চরমভাবে ঘাটতি আছে। এসব ক্ষেত্রে নিরাপত্তা তখনই তৈরি হয় যখন অভিযুক্তদের বাঁচানোর চেষ্টা না করে তাঁদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। তখন সিসি ক্যামেরা বা পুলিশ বসিয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তার কথাও আসে না।চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর যৌন হেনস্তার ঘটনা ঘটে চলেছিল। কিন্তু এ নিয়ে উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছিলেন নির্বিকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ সেলকেও পুরোপুরি অকার্যকর করে রাখা হয়েছিল। সেই সেলে যৌন নিপীড়নের কোনো অভিযোগ গেলে সেগুলো ফেলে রাখা হতো। কারণ, ক্যাম্পাসের যৌন হেনস্তার ঘটনাগুলোর সঙ্গে ঘুরেফিরে ছাত্রলীগের কর্মীরাই সম্পৃক্ত ছিল। তাঁদের চটিয়ে বিরাগভাজন হতে চান না প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পদ–পদবি রক্ষা, ব্যক্তিগত সুবিধা ভোগ, আর্থিক সুবিধা, নিয়োগ বাণিজ্য, উন্নয়ন প্রকল্পের হিস্যা ঠিকঠাক রাখতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতা–কর্মীদের যেমন আস্থায় রাখতে হয়, আবার তাঁদের আস্থায়ও নিজেদের থাকতে হয়।বিক্ষোভরত ছাত্রীদের দাবিগুলোর মধ্যে গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পায়, পুরোনো অভিযোগগুলো দ্রুত সুরাহা করতে হবে। সেই সঙ্গে অকার্যকর সেল ভেঙে নতুন করে গঠন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও উপাচার্য ইতিমধ্যে ছাত্রীদের দাবি বাস্তবায়ন করা শুরু করেছেন। যৌন হেনস্তার পুরোনো অভিযোগগুলোও নিষ্পত্তি করেছেন। গত বছরের ঘটনায় জড়িত ছাত্রলীগ কর্মীদেরও শাস্তি দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ ঘটনায় জড়িতদেরও আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে।শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়ার জন্য আমরা উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাব। তবে গোটা বিষয়টির জন্য অভিবাদন রইল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের, যাঁরা যৌন নিপীড়কদের শাস্তি দিতে ও তাঁদের দাবি মেনে নিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বাধ্য করতে সক্ষম হন।

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সহসম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *